অশোককুমার কুণ্ডু
এমন বর্ণময় হোলির পরত কোথাও দেখিনি। কখনও যুবতীর হাতে কদাচ মার খেয়েছি, মনে পড়ে না। স্মৃতিতে প্রেমের মারের দু’একটি ‘বর্ণহীন’ রামধনু সব কোঠাবাড়িতেই জমা আছে। কিন্তু সেই মার বৃন্দাবনে বর্ণময়। এ হেন বৃন্দাবন আর মথুরায় গিয়ে হোলির রামধনুর হলকায় ভেসেছিল এক আধবুড়ো, এই বয়সেও। মনে হয়েছিল এমন রঙের গুঁড়ো জীবনে সারা বছরে কেন ভেসে বাড়ায় না। তবুও বলি, এ আমার সরল স্বীকারোক্তি, বৃন্দাবনের লাঠমারো এবং মথুরার হোলি জীবনে দেখা সেরা উৎসব। যা রাজস্থান-সহ গোটা উত্তর ভারতে ‘লাঠমারো হোলি’ নামেই বিখ্যাত। অবশ্য এর সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিই নবদ্বীপ-কেষ্টনগরের বৈষ্ণব সংসারে দোলপূর্ণিমার উৎসবও সুন্দর। তফাৎ একটাই, বঙ্গে দোল উৎসব চলে শুধুমাত্র দোলপূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদের দিবাভাগে। কিন্তু মথুরা-বৃন্দাবনে হোলি চলে পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদকে এক সপ্তাহ জিইয়ে রেখে।
বৃন্দাবনে আমার হোলি দেখা হঠাৎ করে, ভিন্ন কাজের চাপে পড়ে। ব্যাপারটা খুলে বলি। হরিদ্বারে পূর্ণকুম্ভ চলে চৈত্র-বৈশাখ মাসে। ঠিক এর এক মাস আগে বৃন্দাবনে যমুনার পাড়ে বসে বসন্তের ‘বৈঠককুম্ভ’ মেলা। হরিদ্বারে পূর্ণকুম্ভ মেলা কভার করার আগে চলে যাই বৃন্দাবন-মথুরায়, বুড়ি ছোঁয়া করি লাঠমারো হোলি। পরের বছর শুধুমাত্র লাঠমারো হোলি দেখতে ওই দুই শহরে মুক্তকচ্ছ হয়ে ঘুরেছি। আবিরে ডুবেছি। নাকে-মুখে বর্ণময় রং, শুকনো এবং তরল, ঢুকেছিল। ঢুকেছিল ক্যামেরার লেন্সের পেটে। সে বেচারির এই হোলিতেই যমুনাপ্রাপ্তি ঘটেছে। ছাদ থেকে, এমন সময়ে এখানে, ঝরে পড়ে বালতি বালতি গোলা রং। এবং শুকনো রং ওড়ে বস্তা বস্তা। এমনকী বড় বড় ‘গরিব’ ব্যবসায়ীরা (কৃষ্ণ-রাধা ভক্ত) হেলিকপ্টার থেকে টাকা ওড়ায়। থুড়ি, পুষ্পবৃষ্টি ঘটায়, আবিরের মেঘ ওড়ায় এই দুই শহরে। ঘণ্টাপিছু বিপুল ব্যয়। অথচ প্রাচীন বৈষ্ণব সাহিত্যের পৃষ্ঠা ধূসর রঙে বিবর্ণ হয়, চুহা-আরশোলা-উইয়ের পেটে যায়।
বৃন্দাবনে সম্বচ্ছর মোবাইলে কলার টিউন ‘রাধে, রাধে’। মথুরায় গান বাজে ‘বরশা বর্ষানিওয়ালে রাধে…’। বাজে ‘লাঠমারো পেয়ারি/হোলি কা দিন আ গয়ি’। এই হোলিতে মথুরা-বৃন্দাবনের আশেপাশের গ্রামগুলো জেগে ওঠে। বলে, রং দে চুনারিয়া। বর্ষার প্রথম দিকে ডিম-ভরা মা-মাছেরা যেমন উজান বেয়ে নতুন জলে এসে জন্ম দেয় নানা বর্ণের, ঠিক তেমনই মথুরা শহর-গড়ানি গ্রামগুলোর কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী এমনকী তাদের অভিভাবকরাও চলে আসেন মথুরায় হোলির রঙে রং মেলাতে। ঘরদোর আগলান বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা।
এমনই এক বুড়ো-বুড়িকে প্রশ্ন করে সেরা রঙিন উত্তর পেয়েছিলাম –- “এত বয়সে কোথায় যাব ? ওরা গেছে হোলিতে। ওরাই তো যাবে। হোলির বয়স। আমরা ঘরে বসে ওদের আনন্দ দেখতে পাচ্ছি। ওদের আবির ওড়ানো, হাসির গান, লাঠমারো, মিঠাই খাওয়া – আমরা এই ঘরে বসেই দেখতে পাচ্ছি সব। তুমি আমাদের কাছে থেকে যাও। ওরা কালই ফিরবে। খুব আনন্দ হবে।”
কৃতজ্ঞতায় হোলির ঝুলি ভরে গিয়েছিল। অপূর্ব এ আমার গ্রামিক ভারত। থেকে গিয়েছিলাম তিন রাত। এটাই নাকি গেস্ট-হোস্টের সহবত। আমাকে নিয়ে গোটা পরিবারটি, পরে পুরো পাড়াটি মেতেছিল, আমায় মাতিয়েছিল। আমি মেহমান। আমি হোলির হঠাৎ আগত বর্ণ। আমি কলকাতার মানুষ, আমি সৌরভ গাঙ্গুলির দেশের মানুষ।
দলে দলে পুরুষরা সুসজ্জিত। সুন্দরী যুবতী, বউরা দল বেঁধে লম্বা লাঠি মারছে ওই পুরুষদের মাথায়। মাথায় তো লাগছে না। পুরুষদের মাথায় রঙিন পাগড়ির ওপর মোটা চটের প্যাডিং। উত্তর ভারতের নারীরা সুন্দরী, ফরসা গায়ের রং। মাথায় রঙিন শাড়ির অনেকটা অংশ, ঝুলন্ত ঘোমটায় মুখ দেখা যায় না। ‘ইয়ে পর্দা হঠা দো, মুখড়া দিখা দো’, মনে মনে গেয়ে উঠি। হাওয়ায় কখনও কখনও উড়ে যায় ঘোমটা, হাসি-মুখের দেখা মেলে। আমি আমন্ত্রণ করি মথুরা-বৃন্দাবনের দ্রুতগামী বাতাসকে, লাঠমারো হোলির ক্ষণে। এই হল লাঠমারো হোলি।
লাঠমারো হোলিতে লাঠি দিয়ে পেটানোর জন্য বরসানার (রাধারানির জন্মগ্রাম) মহিলাকুল পক্ষকাল আগে দল বেঁধে চলে আসে নন্দগ্রামে (নন্দগাঁও, গোপ-রাজার গ্রাম)। নিমন্ত্রণ করে যায় পুরুষদের লাঠির বাড়ি খাওয়ার জন্য। ওই গ্রামে পুজো দেয় প্রথমে, রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে। প্রথমে কৃষ্ণকে নিমন্ত্রণ। নিমন্ত্রণ গাঁওবুড়ো আর মানীদেরও। পালটা নিমন্ত্রণ করেন নন্দগ্রামের পুরুষরা, বরসানার মহিলাদের, মিঠাইয়ের নিমন্ত্রণ। লাঠির বাড়ির প্রতিদানে মিঠাই। আহা! কত পরিশ্রম হয় লাঠি দিয়ে পেটানোর জন্য। বরসানা ও নন্দগ্রামের নারী-পুরুষদের মধ্যে কখনও বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি হয় না। তা হলে তো এই প্রেমের মক-ফাইটিং হবে না। বৈবাহিক সম্পর্কে তো ভাই-বোনের জন্ম হবে। এ এক অদ্ভুত সামাজিক নিয়ম।
কিন্তু কেন নারীরা পুরুষদের পেটায় ? নারীবাদী হলে না হয় বজ্জাত পুরুষদের এ শাস্তি পাওনা। আসলে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনিতে রয়ে গেছে সেই বঞ্চনার চালচিত্রটি। তারই প্রতিশোধ এই মক-ফাইটিঙে, লাঠমারো হোলিতে। যা আবহমান, আজও তা বহতা, বৃন্দাবন-মথুরার আবির-কাহিনিতেও। কালাচাঁদ বজ্জাত প্রেমিক, রসের নাগর, ছল-চাতুর্যে ভরা, কম হেনস্থা করেছে রাধারানিকে। নয়ন জলে ভেসে যাওয়া রাধা। সমগ্র রাত্রি বিবর্ণ, রংহীন, বর্ণহীন, চোখের জলের হয় না কোনও রং। কেষ্ট ব্যাটা সমস্ত রাত চন্দ্রাবলীর ঘরে রাত কাটিয়ে, ভোর-প্রহরে রাধারানির ব্যর্থ বাসরে এসে পায়ে ধরে সাধা। মানভঞ্জনের ইতিবৃত্তে কৃষ্ণের দয়া ভিক্ষা আর রাধারানির ক্ষমার রং দৃশ্যত অদৃশ্য হলেও তা আমার কাছে বর্ণশ্রেষ্ঠ। সাত রঙের সেরা চিত্রময়তা। জীবনের এ এক অপূর্ব রসায়ন। ক্ষমা চাওয়া, ক্ষমা করা এবং ক্ষমা পাওয়া।
সকালে বৃন্দাবনের হোলি না দেখে চলে আসুন। চলে আসুন ৫০ কিলোমিটার দূরের বরসানা-নন্দগ্রামে। দু’টি পড়শি গ্রামে ঘুরুন অটো-গাড়ি ভাড়া করে। বরসানার মন্দির মার্গের মন্দিরের টপ ভিউয়ের উপর উড়ন্ত আবিরের আকাশ। মুনিয়াওয়ালি গলি, রঙ্গিণী গলি থেকে দেখুন গণপথের রং। বিকেলে ফিরে বৃন্দাবনে লাঠমারো হোলি। মথুরা-বৃন্দাবনের হোলিতে কাটিয়ে যান দু’টো দিন।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।