
সদর দরজাতে সাদা কাগজে আলতা দিয়ে লেখা ‘ঝুলন দেখে যান’, ‘পয়সা দিয়ে যান’– ইত্যাদি স্লোগান। দেখে তো ঠাকুরদার চোখ কপালে। এ কী ছেলেখেলা?
ঠাকুমা গলা উঁচিয়ে পাল্টা দেন, খেলাই তো! তোমাদের কেষ্ট যদি…
ময়দানে নামেন মা। মানে মধ্যস্থতা। ঠাকুরদা-ঠাকুমা দ্বৈরথ থামে।
মায়ের সংসারে টান পড়ত। কড়াইয়ের চার ধারে মাটি দিয়ে পুকুর বানানো হত। তাতে ভাসিয়ে দেওয়া হত মাজনে পাওয়া হাঁস। তুলসীতলার মাটিতে ঠাকুরদার পুরনো ধুতির টুকরো মাখিয়ে উল্টো আনাজের ঝুড়িতে ফেলে পাহাড় তৈরি করা হত। দোলের মেলা থেকে নানা পুতুল কেনা হত। সেই সৈন্য, দইওলা, ধানঝাড়ায় ব্যস্ত কৃষককৃষানি, পুকুরে জল আনতে যাওয়া বউ, ইত্যাদি দিয়ে সাদৃশ্যহীন এক মঞ্চ তৈরি করা হত। মাঝে দোলা খেতেন রাধাকৃষ্ণ।
সন্ধ্যাবেলায় পাশের বাড়ির পুরুতদাদা আসতেন পুজো করতে। বাড়ির মা-কাকিমারা আনতেন লুচি-আলুভাজা আর পান্তুয়া। যাঁরা ঝুলন দেখে দক্ষিণা দিতেন তাঁদেরও ডাকা হত। প্রসাদ পেতেন সকলে।
বসত বিনোদনের আসর। ঝুলনের গান, কবিতার সঙ্গে ছোটকা গান ধরত “দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা” । সেই সময়ের হিট গান। ঠাকুমার কণ্ঠে শোনা যেত চণ্ডীদাস — “সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম/ কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিল গো/ আকুল করিল মোর প্রাণ”। কেউ হয়তো ধরতেন, “গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে/কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে।/থির সৌদামিনী রাধিকা দোলে নবীন/ঘনশ্যাম সনে।।/ দোলে রাধা শ্যাম ঝুলন-দোলায়/দোলে আজি শাওনে।।/…”
এই রোম্যান্টিক গীতিকবিতা বাস্তবিকই অন্তরে ঢেউ তোলে। দুলে ওঠে হৃদিযমুনা, ব্যাকুল হয় প্রাণপাখি। স্বর্গের প্রেম নেমে আসে মর্ত্যে। দৈবপ্রেম মানবপ্রেমের মহিমা লাভ করে ধন্য হয়।
বৈষ্ণবদের অবশ্য পালনীয় অনুষ্ঠান হল শ্রীরাধাকৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা। বৃষভানুর কন্যা, আয়ান ঘোষের পত্নী রাধা। মহাভারতে আমরা শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও কার্যকলাপের বিশদ বিবরণ পাই। কিন্তু সেখানে রাধা অনুপস্থিত। রাধা নামে কোনও চরিত্রের দেখা পাই না। এমনকি শ্রীমদ্ভাগবতেও রাধার কোনও উল্লেখ পাই না। সেখানে শুধু পাই কৃষ্ণের এক প্রেমিকা-সখীকে। পরবর্তী কালে ব্রহ্মকৈবর্তপুরাণে, দেবী ভাগবত, পদ্মপুরাণে রাধা আসেন। সে সব জায়গায় রাধার নানা রূপ। কিন্তু ‘রাধা’ কী? ‘রা’ অর্থে লাভ করা আর ‘ধা’ অর্থে ধাবমান হওয়া, শ্রীহরির দিকে ধাবমান হওয়া। ‘ভক্তির’ সাহায্যে ভগবানের সান্নিধ্য পাওয়া। এই আধ্যাত্মিক চেতনা বৈষ্ণব কবিদের কাব্যমহিমায় শেষ পর্যন্ত মানবী-প্রেমের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম মানবিক সম্পদের রূপ নেয়। বিশেষ করে বাঙালির জনজীবনে ও সমাজচেতনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কালক্রমে বৈষ্ণবদের একটি অনুষ্ঠান বাংলার লোকপার্বণে পরিণত হয়।
পরে সজনীকান্ত দাসকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সামনে যাকে পেলাম, তারই হাতে রাখি বেঁধে দিলাম। সরকারি কর্তাব্যক্তি, পুলিশ, কাউকেই বাদ দিলাম না। মনে পড়ে, এক জন কনস্টেবল হাত জোড় করে বলেছিল, মাফ করবেন হুজুর, আমি মুসলমান।
শ্রাবণ মাসের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচ দিন ধরে ঝুলন উৎসব পালন করা হয়। রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ দোলায় স্থাপন করে দোল দেওয়া এই অনুষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ। এখন এই উৎসব শুধু রাধা-কৃষ্ণের মন্দিরে নয়, পাড়ায় পাড়ায় ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরাও এতে মেতে ওঠে। এই ঝুলনে ছোটোরা রাধাকৃষ্ণকে ঘিরে নানা ধরনের পুতুল দিয়ে দৃশ্য তুলে ধরে। দোলনায় দোলেন দেবতা। ছোটোদের হাতের ছোটো টানে দোল খান রাধাকৃষ্ণ। রাতে জম্পেশ খাওয়াদাওয়া। এক সময় পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে ঝুলন হত। যেন এক প্রতিযোগিতার হাট।
কোথাও কোথাও তেরো দিন ব্যাপী এই যাত্রা-উৎসব চলে। উত্তরপ্রদেশের মথুরা, বৃন্দাবন এবং পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুর ও মায়াপুরের ঝুলনযাত্রা বিখ্যাত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু ভক্ত ভিড় জমান মন্দিরে মন্দিরে। পূজার বেদী থেকে তুলে আনা হয় রাধাকৃষ্ণকে। সোনার কিংবা রুপোর দোলায় দুলতে থাকেন দেবতা। সে এক মনোরম দৃশ্য। নিত্যনতুন পোশাক আর ফুলে ফুলে সেজে ওঠে দোলা। রকমারি ভোগ দেওয়া হয় দেবতাকে। পরে তা ভক্তদের বিতরণ করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের শতনাম, কীর্তন, ভজন ও আরতি হয় দিনরাত।
আমেদাবাদের কৃষ্ণ মন্দির, বেঙ্গালুরুর হরেকৃষ্ণ হিল ও বৈকুণ্ঠ হিল, ভুবনেশ্বরে কাঠিয়াবাবার আশ্রম, বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারী, মথুরার দ্বারকাধীশ মন্দিরেও জাঁকজমক সহকারে ঝুলন উৎসব পালিত হয়। নদীয়া জেলার পালপাড়াস্থিত শ্রী মহেশ পণ্ডিতের বাড়ি, শ্রীপাট শান্তিপুরে শ্রীরাধাকৃষ্ণ মন্দিরে ঝুলনযাত্রা পালিত হয়। শ্রীধাম পুরীতে দশমী থেকে সপ্তাহব্যাপী ঝুলন উৎসব ও মেলা বসে।
এ ছাড়াও ঝুলন হয় বরাহনগরে শ্রীপাঠবাড়ি আশ্রম, হাওড়া শিবপুরে বঙ্গীয় নিম্বারক আশ্রম, সুখচরের শ্রীরাধামা গোপালজি মন্দির, বেলুড় রাসবাড়ি, টালিগঞ্জের বড় রাসবাড়ি, রাসবিহারীর রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও শীলপাড়ার ভজনাশ্রমে।
ঝুলনযাত্রার শেষ রাখিপূর্ণিমায়। রাখি বেঁধে দেওয়ার চল কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা আজ আর জানার উপায় নেই। এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে ভারতের সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গেই যেমন কোনও না কোনও পৌরাণিক কাহিনি জড়িত, ঠিক তেমনই রাখির বাঁধার পেছনেও রয়েছে এ রকমই এক কাহিনি। দেবতা-অসুরদের সংগ্রাম চলছে। কিন্তু জয় কী ভাবে আসবে? দেবরাজ ইন্দ্র চলেছেন বৃহস্পতির কাছে জয়ের উপায় জানতে। পথ আটকালেন ইন্দ্রাণী। বললেন, তিনি জানেন জয়ের উপায়। সেই উপায়েরই অঙ্গ হিসাবে ইন্দ্রাণী পরের দিন শ্রাবণী পূর্ণিমার রাতে স্বামীর হাতে বেঁধে দিলেন রক্ষাকবচ। সেই রক্ষাকবচই হল রাখি। পৌরাণিক কাহিনিতে স্ত্রী রাখি বেঁধে দিয়েছিলেন স্বামীর হাতে। সময় গড়িয়ে যায়, রীতি পালটায়। এখন বোনেরা রাখি পরিয়ে দেয় ভাইদের হাতে।
কিন্তু রাখিবন্ধন বলতেই বাঙালির মনে পড়ে যায় সেই ইতিহাসের কথা, লর্ড কার্জনের সেই বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের কথা আর তার প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পথে নেমে রাখি বাঁধার কথা। ১৯০৫-এর সেই দিন। ১৬ অক্টোবর। আজ থেকেই কার্যকর বঙ্গভঙ্গ। বাঙালির ঘরে ঘরে অরন্ধন। কলকাতায় হরতাল। শহরের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি, অগণিত মানুষ মিছিল করে চলেছেন গঙ্গাতীরে। মিছিলের পুরোভাগে কবি। সবাই গঙ্গাস্নান করে পরস্পরের হাতে রাখি বেঁধে দিলেন। পরে সজনীকান্ত দাসকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সামনে যাকে পেলাম, তারই হাতে রাখি বেঁধে দিলাম। সরকারি কর্তাব্যক্তি, পুলিশ, কাউকেই বাদ দিলাম না। মনে পড়ে, এক জন কনস্টেবল হাত জোড় করে বলেছিল, মাফ করবেন হুজুর, আমি মুসলমান।
কিন্তু সে দিন তো হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান বলে কোনও বাছবিচার ছিল না। সে দিন তো ছিল রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ। সে দিন বাঙালিমাত্রই বেঁধেছিল রাখি। ঐক্যের রাখি।
তাই ঝুলনপূর্ণিমা এলেই বাঙালির মনে পড়ে যায় রাখি বাঁধার কথা। আর রাখিবন্ধনের কথা এলেই মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথকে, যে কবি জড়িয়ে আছেন আমাদের জীবনে, আমাদের মননে।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।