শম্ভু সেন
‘হ্যাপি হোলি’। ‘শুভ দোলযাত্রা’। আগাম এসএমএস আসতে শুরু করে দিয়েছে। মোবাইলের ইনবক্স যতই ভরে যাচ্ছে শুভ বার্তায়, ততই হয়ে পড়ছি নস্ট্যালজিক, ততই ফিরে যাচ্ছি কৈশোরের দিনগুলোতে।
পাশের গলিতে জড়ো করা হয়েছে যত রাজ্যের খড়কুটো, খড়ের আঁটি, গাছের ডালপালা, শুকনো পাতা, কাঠ, আরও নানা দাহ্য বস্তু। আমরা সবাই সন্ধের প্রতীক্ষা। তর সয় না। সন্ধে নামতেই বাবার হাত ধরে অকুস্থলে হাজির। আগুন দেওয়া হল স্তূপীকৃত দাহ্য-জঞ্জালে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠতেই আমরা চিৎকার করে বলে উঠলাম ‘আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল’।
বাড়ি ফিরেই আমরা ভাইবোনেরা ঘিরে ধরলাম বাবাকে। সেই আসরে সঙ্গী মা-ও। বাবা বলতে শুরু করলেন —
কেউ বলেন ন্যাড়া পোড়ানো, কেউ বা বলেন চাঁচর, আবার কেউ বলেন ম্যাড়া পোড়ানো, কোথাও আবার বুড়ির ঘর পোড়ানো। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ঘটনাটা এক। দোলের আগের দিন এই যে বহ্ন্যুৎসব, আদতে এ হল হোলিকাদহন। স্কন্দপুরাণে হোলিকা ও প্রহ্লাদের গল্প আছে। হোলিকা দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন, প্রহ্লাদের পিসি। প্রচণ্ড নিষ্ঠুর ছিল দুই ভাইবোন। ব্রহ্মার আশীর্বাদে হিরণ্যকশিপু অপরাজেয় থাকার বর পেয়েছিল। তাই কোনও দেবতাকেই মানত না সে। বলত দেবতা নয়, পুজো তাকেই করতে হবে। কিন্তু হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিল বিষ্ণুর ভক্ত। সে তার বাবার আদেশ মানতে রাজি নয়। হিরণ্যকশিপু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। নানা ভাবে ছেলেকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ফল হল না। শেষে প্রহ্লাদকে ভুলিয়েভালিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে জ্বলন্ত চিতায় বসল হোলিকা। নিজে গায়ে দিল অগ্নি-নিরোধক শাল। কিন্তু আগুন জ্বলে উঠতেই সেই শাল উড়ে গিয়ে ঢেকে ফেলল প্রহ্লাদকে। অগ্নিদগ্ধ হল হোলিকা। বিষ্ণুর আগমন ঘটল। তাঁর হাতে নিহত হল হিরণ্যকশিপু।
বাবা বুঝিয়ে দিলেন, দহনের এই আগুন হল অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়ের প্রতীক। এই উৎসবটির মধ্য দিয়ে ভালো কাজের জয় আর মন্দের ক্ষয়কেও বোঝানো হয়ে থাকে। আগুনকে শক্তির প্রতীক হিসেবে মনে করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে অমঙ্গল বা কুপ্রভাবকে ধ্বংস করা হয়। হোলি শব্দটা এসেছে হোলিকা থেকে। হোলিকা দহনের পরের দিন আনন্দে রঙের খেলায় মেতে ওঠে সবাই। পালিত হয় হোলি।
পুরাণ ছাড়া বেদেও হোলি উৎসবের উল্লেখ আছে। বেদ-পুরাণ ছেড়ে বাবা ইতিহাসের কথাও শোনালেন। বললেন, পূর্ব ভারতের আরিয়ান নামে এক জাতি নাকি এই উৎসবের প্রচলন করে। যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগেকার এক ভাস্কর্য, মানে পাথরের গায়ে খোদাই করা শিল্পকর্মের নমুনা থেকে এই উৎসব প্রচলিত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এর পরে আরও বহু মন্দিরের গায়ে খোদাই করা শিল্পকর্মে হোলি উৎসবের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। তত দিনে ভারতীয় সাহিত্যেও হোলি জায়গা করে নিয়েছে। আর্যরা এই উৎসব পেয়েছিল অনার্যদের কাছ থেকে। ‘হোলক’ বা ‘হোলাক’ মানে ডাইনি। ডাইনির রোষ থেকে আগামী ফসল বাঁচানোর এবং ভালো শস্য উৎপাদনের প্রার্থনায় হোলি উৎসব শুরু করেছিল তখনকার মানুষ। জ্বালানো হত পুরনো শস্যের খড়। অর্থাৎ হোলি আদতে হল ভারতের কৃষিনির্ভর সমাজের ফসল উৎপাদন সম্পর্কিত উৎসব। কালক্রমে যা ধর্মীয় মোড়ক পায়।
বাবা বললেন, এই ন্যাড়াপোড়া, চাঁচর বা হোলিকাদহন, যা-ই বলিস, এর একটা অন্য দিকও আছে। এটা একটা প্রতীকী ব্যাপার। এই সময় পড়ে থাকা গাছের শুকনো পাতা, ডালপালা জড়ো করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। শীত হল পাতা ঝরার বেলা। শীতের রুক্ষতা, শুষ্কতা, জড়তা কাটিয়ে আসে বসন্ত। গাছে গাছে আসে নতুন পাতা। জীবনেও আসে নতুন উন্মাদনা, কর্মচাঞ্চল্য। রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছেন, ‘প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে’। পাতা ঝরার সময় ফেলে এসে আমরা প্রতীক্ষা করি বৈশাখের, নতুন বছরের। ফেলে আসা ঋতুর পুরনো জঞ্জাল, রুক্ষতা, শুষ্কতা সরিয়ে আমরা নতুনের আহ্বান করি এই বহ্নি-বাসরের মাধ্যমে।
কিন্তু বাংলাদেশে তো হোলি নয়, পালিত হয় দোলযাত্রা।
আমাদের সমস্বর মন্তব্যের রেশ ধরে বাবা ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন —
এক সময় উত্তর আর পশ্চিম ভারতের হোলির সঙ্গে বাংলাদেশের দোলযাত্রার কোনও সম্পর্ক ছিল না। পরবর্তী কালে হোলি আর দোল সমার্থক হয়ে গিয়েছে। তবুও হোলি উদযাপনের মধ্য দিয়ে প্রধানত ভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনিই স্মরণ করা হয়। কিন্তু আমরা দোলযাত্রা বা দোলপূর্ণিমা বা দোল উৎসবের মধ্য দিয়ে স্মরণ করি রাধাকৃষ্ণের দোল খেলাকে। এ নিয়ে একটা সুন্দর গল্প আছে। একটা গান আছে না – ‘যশোমতী মাইয়া সে পুছে নন্দলালা, রাধা কিঁউ গোরি, ম্যায় কিঁউ কালা’। মায়ের কাছে এই অভিযোগটা প্রায়ই করত নন্দদুলাল। তাই এক দিন বিরক্ত হয়ে মা যশোদা বললেন, ঠিক আছে তোর যা খুশি রঙ রাধার মুখে মাখিয়ে দে। রাধার মুখের রঙ পালটে যাবে। কথাটা বেশ মনে ধরল কৃষ্ণের। ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন রাধাকে আবিরে-গুলালে মনের মতো করে রাঙিয়ে দিলেন শ্রীকৃষ্ণ। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে রাধা ও তাঁর সখিদের সঙ্গে আবির খেলায় মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এ দিন রাধাকৃষ্ণের যুগলবিগ্রহ আবিরে রাঙিয়ে দোলায় চড়িয়ে নগর সংকীর্তন বের করা হয়। রাধাকৃষ্ণের সেই রঙের খেলাকে স্মরণ করে বাঙালিরা মেতে ওঠে দোল উৎসবে।
বাবা জানিয়ে দিলেন, বাঙালিরা যখন দোল খেলেন, পরের দিন উত্তর ও পশ্চিম ভারতের মানুষজন খেলেন হোলি বা হোরি। অসম আর ওড়িশার মানুষজনও কিন্তু দোল খেলেন। কোঙ্কণ উপকূলবাসীরা খেলেন ‘শিমাগা’, দক্ষিণ ভারতীয়রা খেলেন ‘মদনদহন’ বা ‘কামায়ন’।
বাঙালিদের কাছে এই দোলপূর্ণিমা দিনটির যে আরেকটি তাৎপর্য আছে বাবা তা মনে করিয়ে দিলেন। এই পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীচৈতন্য ছিলেন ষোড়শ শতকের হিন্দুধর্ম ও সমাজ সংস্কারক। তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে পুজো করে বাঙালি সমাজ। ‘হরেকৃষ্ণ’ মন্ত্র তিনিই জনপ্রিয় করেন। ‘হরেকৃষ্ণ’ ডাক দিয়ে তিনি তৎকালীন সামাজিক বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর ভক্তি আন্দোলনে তিনি শামিল করেছিলেন সব শ্রেণি, সব ধর্মের মানুষকে। তাই এই দোলপূর্ণিমা বাঙালিদের কাছে ‘গৌরপূর্ণিমা’ নামেও পরিচিত।
আমরা এক সঙ্গে গাইতে শুরু করলাম, ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এ বার যাবার আগে…’।
বাবা বললেন, রবীন্দ্রনাথের এই গানেই দোলযাত্রার মূল সুরটা ফুটে ওঠে। কবি দোলপূর্ণিমার দিনটিকে এক অনন্য অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে দোলের দিন রঙে রঙে আকাশ রাঙিয়ে নাচ-গান-আবৃত্তি-নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে বরণ করা হয় বসন্তকে। দোলের দিন সকালে ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল’ গানটির মাধ্যমে বসন্তোৎসবের মূল অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। শাল, পলাশ, শিমূলে ঘেরা শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি আবির-রঙ-সঙ্গীতের ছোঁয়ায় যেন হয়ে ওঠে নবীন, রঙিন।
আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। রাত পোহালেই দোল। বালতি বালতি জল-রঙে ভিজে যখন ঘরে ফিরব, মা সাবান মাখিয়ে ঠান্ডা জলে স্নান করিয়ে দেবেন। গা-টা শিরশির করে উঠবে। শীতের শেষ পরশ। মনে হবে, চলে যাওয়ার আগে শীত যেন জানান দিয়ে যাচ্ছে, আমি ছিলাম।
সম্বিত ফিরল। বর্তমানে ফিরে এলাম। আসলে দোল হল জীবনের উৎসব। আমাদের জীবন সব সময় এক তালে, এক সুরে চলে না। সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তি, উত্থান-পতন, হাত ধরাধরি করে চলে। জীবন পরিবর্তনশীল। আর দোল উৎসব সেই বার্তা বয়ে আনে, যা জীবনের দুঃখ-দৈন্য-ব্যথা-বেদনা ভুলে এগিয়ে যেতে উৎসাহ জোগায়। জীবন আনন্দরসে পূর্ণ করে তোলার আহ্বান জানায় দোল উৎসব।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।