খুব কম খরচে আমার বাঙালি যেন থাকে মাছে-ভাতে

0
Telapiya farming on rooftop

সম্রাট বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথমেই বলি আমি জানি আমি মাছের ব্যাপারে খুবই কম জানি। কিন্তু আমার চেয়েও এ ব্যাপারে কম জানেন এমন অনেক বন্ধু আছেন।

এই লেখা মূলত তাঁদের জন্য যাঁরা বাড়ির ছাদে, বারান্দায় বিষমুক্ত চাষ শুরু করেছেন বা করার চেষ্টা করছেন। তাঁরা নিজের পরিবারের সদস্যদের ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য বিষমুক্ত খাদ্য জোগাড় করার চেষ্টা করে চলেছেন।

আমি এটাও জানি আমার বন্ধুতালিকায় মাছের বিষয়ে অনেক বেশি জানেন এমন কিছু মানুষও আছেন। তাঁদের কাছে অনুরোধ আপনারা আপনাদের কষ্টার্জিত জ্ঞান ভাগ করে আমাদের সবাইকে সমৃদ্ধ করুন।

মাছ ছাড়া বেশির ভাগ বাঙালির দুপুরের খাওয়া সম্পূর্ণ হয় না বা কী কী মাছ বাঙালি খেতে পছন্দ করে সে বিষয়ে আলোচনা করছি না। আজকের আলোচনার বিষয় হল বিনা খরচে বা অত্যন্ত স্বল্প খরচে কী ভাবে বাঙালি সারা জীবন মাছ খেতে পারে!

প্রথমেই বলি গ্রাম বাংলার কথা। ‘গ্রামের মানুষ নিজেদের পুকুর থেকে মাছ ধরে খায়’, এটা কিন্তু অনেক পুরোনো একটা ধারণা। বিগত কয়েক বছর ধরে গ্রামে বসবাস করার জন্য দেখতে পাই গ্রামের মানুষ রীতিমতো পয়সা খরচ করে মাছ কিনেই খান এবং দামটাও কিন্তু বড়ো শহরের তুলনায় খুব একটা কম নয়। টাটকা রুই বা কাতলা এখানে একটু বড়ো সাইজের (দু’ কিলোগ্রাম) হলে প্রতি কিলোগ্রাম ৩০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। এটা কিন্তু গোটা মাছের দাম (প্রতি কিলোগ্রাম হিসেবে) বললাম। কেটে নিলে দামটা ৪২৫ টাকা থেকে ৪৫০ টাকায় অনায়াসে পৌঁছে যাবে। পুজোপার্বণে দাম আরও বাড়ে। শহরের বন্ধুরাও নিশ্চয়ই বেশ ভালো দাম দিয়েই রোজের মাছ কিনে থাকেন।

ছোট্ট ফ্ল্যাট বা বাড়িতে মাছ চাষ

আলোচনার আজকের পর্বে আমরা কিন্তু গ্রামের নয়, শহরের ছোট্ট ফ্ল্যাট বা বাড়িতে কী ভাবে মাছ চাষ করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করব। শহরের ফ্ল্যাট/বাড়ি যত ছোটোই হোক না কেন, একটা ছোটো আকারের বারান্দা কিন্তু থাকেই। যদি আমরা একটা ৫০০ লিটারের প্লাস্টিক/ফাইবার ট্যাঙ্ক (নতুনের দাম ২৫০০ টাকা হলেও পুরোনো ৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় একটু খোঁজ করলেই। ফ্রিতেও পেতে পারেন) সেই বারান্দায় সেট করে দেশি তেলাপিয়া, কই, মাগুর, ট্যাংরা, শিঙি জাতীয় কষ্টসহিষ্ণু মাছ চাষ করতে পারি তা হলে কিন্তু মাছের জন্য মাসের শেষে পকেটের উপর চাপ পড়বে না।

এই ধরনের মাছ চাষ করতে গেলে বিশেষ কোনো ট্রেনিং বা রকেট সায়েন্স, কিছুই শিখতে হবে না। দিনে দু’ বার শুধু খাবার দেবেন আর সপ্তাহে দু’-তিন বার চৌবাচ্চার জল ৫০% পালটাবেন। ওই ৫০% জলটাও ফেলে না দিয়ে সবজি চাষের জন্য কাজে লাগবে। যাঁরা বাড়িতে টবে সবজি বা ফুলচাষ করছেন তাঁদের বলছি, আর কখনও সার কিনতে হবে না। ওই জলটাই আপনার গাছের সার। মাছের খাবার নিজে বাড়িতে কী ভাবে তৈরি করবেন এবং সেটাও প্রায় বিনামূল্যে সেটা এই লেখার শেষে আছে। ব্যস, এতটাই সোজা পুরো বিষয়টা!

ট্যাঙ্ক জোগাড় করে কী ভাবে সেট করবেন সেটা শিখিয়ে দেব। টিউশন ফি লাগবে না। তবে প্রথম ফসল (মাছ) তোলার পর একবার ছবি/ভিডিও পাঠাতে ভুলবেন না।

এখানে একটা প্রশ্ন অবধারিত ভাবে আসবে, “আমি রুই, কাতলা, ইলিশ, পাবদা, ভেটকি ছাড়া অন্য মাছ খাই না। তা হলে আপনার বলে দেওয়া এই সব ফালতু (!) মাছ কেন চাষ করব”?

উত্তর হল: খেতে হবে না এই সব দেশি মাছ। আপনি আপনার পছন্দের মাছই খাবেন। আমার কাজ হল আপনার পাতে মাছের জোগান নিশ্চিত করা, সেটাও আবার বিনা মূল্যে বা অত্যন্ত স্বল্প মূল্যে। কাজটা আপনিই করবেন। আমি শুধুমাত্র রাস্তাটা দেখাব।

এ বার প্ল্যানটা বলি?

দেশি তেলাপিয়া মাছের বয়স ৭৫ দিন হলেই প্রজননক্ষম হয় এবং বছরে বেশ কয়েক বার বাচ্চা দেয়। মানে গোটা দশেক মাছ চৌবাচ্চায় ছাড়লে ৬ মাসের মধ্যে কয়েক হাজার হয়ে যাবে সংখ্যায়।

প্রতি তিন মাস অন্তর আপনাকে চৌবাচ্চা থেকে বড়ো মাপের মাছগুলো বের করে নিয়ে স্থানীয় মাছব্যবসায়ীকে বেচে দিতে হবে। কাজটা শুনতে ঝামেলার হলেও খুব একটা কঠিন নয়। আপনার বাড়ি থেকেই প্রতি তিন মাস অন্তর একটি নির্দিষ্ট দিনে স্থানীয় মাছব্যবসায়ী নগদ টাকা দিয়ে আপনার ফসল (মাছ) কিনে নিয়ে যাবেন। ধরুন প্রতি কিলোগ্রাম মাছের জন্য আপনি ১০০ টাকা দাম পাচ্ছেন। তা হলে ১০ কিলোগ্রাম মাছ ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ বার ওই ১০০০ টাকায় আপনি অন্য যে কোনো মাছ কিনে খান। কিন্তু এটা মাথায় রাখবেন যে মাছটা কিনে খাচ্ছেন তার মধ্যে সারবস্তু কতটা আছে আপনি জানেন না। অথচ আপনার চৌবাচ্চায় বড়ো হওয়া মাছটা কিন্তু প্রায় অর্গানিক।

এ বার বলি মাছের খাবার কী ভাবে বানাবেন

সপ্তাহে একদিন ৫০০ লিটারের ট্যাঙ্কে (জল থাকবে ৪৫০ লিটার) ১০ মিলিলিটার পরিমাণ রসগোল্লার রস অথবা ১০ গ্রাম চিটেগুড় ১ লিটার জলে ভালো করে গুলে মিশিয়ে দিন। না মশাই, মাছ রসগোল্লা খায় না। তবে কি জানেন ওদের তো আর আপনার মতো আলাদা শৌচালয় নেই, জলেই করে প্রাকৃতিক কাজকর্ম, আর যেটা করে তাতে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন থাকে। এখন রসগোল্লার রসে থাকে চিনি। আমরা সবাই জানি চিনি বা গুড় খুব ভালো কার্বন সোর্স। এ বার নাইট্রোজেন কার্বন সোর্সের সঙ্গে মিলে কী বানাবে? ঠিক বলেছেন, খুব ভালো কোয়ালিটির প্রোটিন বানাবে। তার মানে মাছ নিজের বর্জ্যই খাবে, বারবার খাবে এবং বড়ো হবে। ট্যাঙ্কের পরিবেশও থাকবে সুস্থ।

এ ছাড়াও সপ্তাহে একদিন সামান্য বাদামখোল আর গমের ভুষি মিশিয়ে দিতে হবে। কী ভাবে মেশাবেন? কতটা দেবেন? সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেব। আপনি শুরু তো করুন।

ফোন নম্বর রইল ৭০৪৪৭৯১৪৩৬। বিরক্ত করে বাধিত করবেন।

ধন্যবাদ

*একটু ছোট্ট করে নিজের ঢাকটা পিটিয়ে নিই? স্বল্প জলে মাছ চাষ করছি ২০১৬ থেকে এবং এখনও পর্যন্ত আমার সাফল্যের হার কিন্তু ৯৯%।

আরও পড়তে পারেন: পুকুরে মাছ চাষের সময় মাথায় রাখুন এই ৫টি বিষয়

বিজ্ঞাপন