উন্নত মানের চিকিৎসাব্যবস্থা সত্ত্বেও গোটা বিশ্বে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ল্যানসেটের গবেষণায় দেখা গেছে, ২৩টি কারণ রয়েছে স্ট্রোক হওয়ার। এর মধ্যে অন্যতম যেমন অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান ও শারীরিক কসরত না করে অলস জীবনযাপন, তেমনই অন্যতম প্রধান কারণ হল বায়ুদূষণ। মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন আচমকা বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কের কোষ পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। কার্যকারিতা হারিয়ে শুকিয়ে যেতে পারে মস্তিষ্কের কোষ, এতে ক্ষতি হয় মস্তিষ্কের। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ইদানীং প্রতি বছর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ৭০ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। ল্যানসেটের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২১ সালে গোটা বিশ্বে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৯ লাখ। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৭৩ লাখ মানুষের।
মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে স্ট্রোক। ১৯৯০ সাল থেকে স্ট্রোকে আক্রান্তর সংখ্যা বেড়েছে ৭০%। গোটা বিশ্বে আজ ৯৩.৮ মিলিয়ন তথা ৯ কোটি ৩৮ লক্ষ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন অসুখে ভুগছেন। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কম ও মধ্য আয়ের দেশের মানুষ। স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে ৩২%।
শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যে বায়ুদূষণের প্রভাব
বায়ুদূষণ শুধু স্ট্রোকেরই কারণ নয়, বায়ুদূষণ মানসিক উদ্বেগ, অবসাদ, সাইকোসিসের মতো সমস্যাও বাড়িয়ে তোলে। একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য। মাতৃগর্ভে থাকার সময়, শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনকালে বায়ুদূষণের কী প্রভাব একজন ব্যক্তির ওপর পড়ে তা নিয়ে এই গবেষণা চালানো হয়। মানসিক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও সাইকোসিসের কী প্রভাব পড়ছে তা নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় ওই গবেষণায়। ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই গবেষণা চালান। গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে The Journal of the American Medical Association (JAMA) Network Open নামক জার্নালে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাতাসে বায়ুদূষণ সৃষ্টিকারী পিএম২.৫-এর মাত্রা কিউবিক মিটারপিছু ০.৭২ মাইক্রোগ্রাম বাড়লে সাইকোসিসের সমস্যা বাড়ে ১১% আর মানসিক উদ্বেগ ও অবসাদের সম্ভাবনা বাড়ে ১০%। গবেষকরা দেখেন, গোটা বিশ্বেই বাড়ছে বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের মারাত্মক প্রকোপ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানসিক সমস্যাও। গর্ভাবস্থা ও শৈশবে বায়ুদূষণের কবলে থাকলে মানসিক উদ্বেগ ও অবসাদের আশঙ্কা বাড়ে। তেমনই শৈশব ও কৈশোরে শব্দদূষণের মারাত্মক কবলে পড়লে মানসিক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে ১৯-২২%।
ভারতের চিত্র
বিশ্বের পাশাপাশি ভারতেও মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণ সব বয়সি মানুষের জন্যই অকাল মৃত্যুকে ডেকে আনছে। মুম্বইয়ের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সেসের বিজ্ঞানীরা দেশের ৭০০-এরও বেশি জেলায় বায়ুদূষণের কারণ বাতাসে ক্ষতিকর পিএম২.৫ পলিউশন লেভেল নিয়ে গবেষণা চালান। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য ন্যাশনাল ফ্যামিলি অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ও ন্যাশনাল অ্যাম্বিয়েন্ট এয়ার কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ডে নথিবদ্ধ হয়েছে। গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে GeoHealth নামক জার্নালে।
সম্প্রতি The Lancet Planetary Health Journal-এ প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, কলকাতা-সহ ভারতের ১০টি শহরে গড়ে প্রতি বছর ৩৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে শুধু বায়ুদূষণের কারণে। বায়ুদূষণের কারণে ভারতে স্বাস্থ্য খাতে খরচের পরিমাণ বাড়ছে বলেও দাবি করা হয়েছে ল্যানসেটের গবেষণায়। বায়ুদূষণের কারণে বাড়ছে শ্বাসকষ্টের অসুখ, ফুসফুসের রোগ, হৃদযন্ত্রের অসুখ।
International Neurotoxicology Association journal-এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, দূষিত পরিবেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে একটানা থাকলে তা শুধু ফুসফুসের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না ঘুমের প্যাটার্নও বদলে যায়। বায়ুদূষণের কারণে অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে আচমকা নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা বাড়ে। জ্বালানি তেল পোড়ানো ও গাড়ির ধোঁয়ার জন্য নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নামক দূষিত পদার্থ তৈরি হয়। এর জেরে স্লিপ অ্যাপনিয়ার সমস্যা বাড়ে। পাশাপাশি, বায়ুদূষণের ফলে অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম প্রভাবিত হয়। টাইপ টু ডায়াবেটিস ও হার্টের অসুখের সমস্যা দেখা যায়। সুইৎজারল্যান্ডের সংস্থা আইকিউএয়ারের করা সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২৩ সালে বিশ্বের ১৩৪টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বাতাসের গুণমানওয়ালা দেশের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে ভারত। ভারতের আগে রয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান।