শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্রাজেডি ‘হ্যামলেট’-এর প্রধান চরিত্র তথা ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেটের মুখে ছিল বিখ্যাত স্বগোতক্তি, “To be, or not to be, that is the question:/ Whether ’tis nobler in the mind to suffer/ The slings and arrows of outrageous fortune,…”।
এমন সিদ্ধান্তহীনতায় হ্যামলেটের মতো আমরা অনেকেই ভুগি। সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে সমস্যায় পড়ি, সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হই। অনেকেই হয়ত একে সামান্য সিদ্ধান্তহীনতা বলে বর্ণনা করবেন কিন্তু মনোবিজ্ঞানীদের মতে এটি একরকমের মানসিক সমস্যা। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলা হয় ‘ডেসিডোফোবিয়া’ (Decidophobia) বা সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাওয়া, আতঙ্কগ্রস্ত হওয়া। এর জেরে মনের মধ্যে তৈরি হয় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। পরিস্থিতি থেকে পালানো ও এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন এই মানসিক সমস্যার জেরে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়, তেমনই কাজের ও ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হয়। অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন, এই আশঙ্কায় ভোগেন। ভাবেন তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। পরে এ নিয়ে আপশোশ করেন।
কী করে বুঝবেন আপনি ডেসিডোফোবিয়ায় ভুগছেন
বিভিন্ন গবেষণায় মনোবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, বেশির ভাগ সময়ই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই যদি কোনো ব্যক্তি অপরিসীম আতঙ্ক ও উদ্বেগে ভুগতে থাকেন, নেতিবাচক চিন্তা করে ভাবেন তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাহলে হলফ করে বলা যায় ওই ব্যক্তি ডেসিডোফোবিয়ায় ভুগছেন। এমন মানসিক সমস্যায় আক্রান্তরা সবসময় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার দোলাচালে ভোগেন। বেশির ভাগ সময় স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সিদ্ধান্ত নিলেও কাজের আগেই প্যানিক করেন।
ডেসিডোফোবিয়ার উপসর্গ কী কী
সিদ্ধান্ত নেওয়ার আতঙ্কে প্যানিক অ্যাটাক হয়। অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগের কারণে বুকে ব্যথা, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন, হাত-পা কাঁপা, জিভ শুকিয়ে যাওয়া, বমিবমি ভাব, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরার মতো শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। এমন ব্যক্তিদের জীবনযাপনও ব্যাহত হয়। ভবিষ্যতে কী হবে ভেবেই বর্তমানকে নষ্ট করেন। অদ্ভুত অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটান।
এ ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবনে ছোটোখাটো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অন্যদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার জন্য আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যায়। নিজেদের কোনো চাহিদা পূরণ হয় না। আর্থিক বিনিয়োগ বা সঞ্চয়ে অসুবিধা হয়। আতঙ্কে কাজের সুযোগ হারায় এমন ব্যক্তি। ব্যক্তিগত সম্পর্কে টানাপড়েন হয়।
কেন হয় ডেসিডোফোবিয়ার মতো মানসিক সমস্যা
অতীতে কোনো ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা হলে অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ভয়ে, আতঙ্কে ভোগেন।
ছোটোবেলায় শিশুদের হয়ে সব সিদ্ধান্ত পরিবারের গুরুজনেরা নেন। একটা বয়সের পর অনেকেই ভাবতে পারেন না নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বা সেই ব্যক্তির নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। এতে করে অন্যদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা তৈরি হয়ে যায়। এ সবের কারণেও এমন মানসিক সমস্যা দেখা যায়।
পারিবারিক কারণে, জিনগত সমস্যার কারণেও এমন মানসিক সমস্যা হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় কোনো বিষয় নিয়ে বাবা-মায়ের মধ্যে ফোবিয়া সন্তানের মনেও চারিত হয়েছে। বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভোগা ব্যক্তি নিজেদের ভাবমূর্তি নিয়ে এত বেশি সচেতন ও খুঁতখুঁতে থাকেন যে এমন মানসিক সমস্যা হতে পারে।
ডিপেন্ডেন্ট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভোগা ব্যক্তিরও এমন মানসিক সমস্যা হতে পারে। ব্যর্থ হওয়ার আতঙ্ক বা ফোবিয়াকে বলা হয় অ্যাটিচিফোবিয়া (atychiphobia), নিখুঁত না হওয়ার ভয় বা ফোবিয়াকে বলা হয় অ্যাটেলোফোবিয়া (atelophobia)। এমন মানসিক সমস্যা থাকলেও হতে পারে ডেসিডোফোবিয়ার সমস্যা।