সমর মিত্র: এ এক অন্য কালীপুজো। এই কালী দীপাবলির সঙ্গী নন। ইনি পূজিতা হন প্রখর গ্রীষ্মে। জ্যৈষ্ঠের এক শনিবার। পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানার আঝাপুর গ্রামের পুব পাড়ায়। এটি প্রথমে ছিল এক সরকার বংশের ঠাকুর। পরে ওই সরকাররা গ্রামেরই যোগীন্দ্রনাথ মিত্রকে ঠাকুর সমেত বিশাল জায়গা বিক্রি করে দিয়ে অন্যত্র চলে যান। যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন মহানাস্তিক। তিনি নাকি বলতেন, তোদের মা কালীর মাথা আমি এই হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দেব আর সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত অবশ করে দিতে হবে। ছ’ মাস এক বছর পরে কিছু হল আর তোরা বলবি মা কালীর রোষে এমন হয়েছে, তা হবে না। উনি নাকি বলতেন, মরার সময় আমার মুখে গঙ্গাজল দিবি না, মুরগির জুস দিবি। বেশ কিছুক্ষণ মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে পারব। কিন্তু দেবীপূজায় তিনি আপত্তি জানাননি। তাঁর বংশধরেরা আজও দেবীর নিত্যপূজার ব্যবস্থা করেন। শুধু বছরের ওই একটি দিন পুজো বারোয়ারির। সে দিন গাঁয়ের মানুষরাই পুজোর ব্যবস্থা করেন। এক বছর ওই পুজোর সময় একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। তার পর থেকে এই পুজো এক অন্য মাত্রা পায়। সে বার পুজো হচ্ছিল এক মঙ্গলবার। প্রধান পুরোহিত এলাকার বিশিষ্ট সংস্কৃত অধ্যাপক কাব্য ব্যকরণ স্মৃতি শাস্ত্রী। সঙ্গে উপযুক্ত সহযোগী। পুজোর মাঝেই মন্দির প্রাঙ্গণের এক কোণে বসে থাকা এক বধূ হঠাৎ চিৎকার করে উঠে দাঁড়ান। মাথা নাড়তে নাড়তে একেবারে সামনে এসে দৃঢ় কণ্ঠে জানান, এ পুজো হচ্ছে না। মঙ্গলবার পুজো হতে পারে না। মায়ের পুজো হবে তোমাদের সুবিধেমতো? পুজো বন্ধ করো। বধূটি নির্দেশ দিল। সেই নির্দেশের সামনে বিখ্যাত পণ্ডিত বাক্যহারা। কিছুটা সন্ত্রস্তও। অশিক্ষিত অন্ত্যজ শ্রেণির এক মহিলার তেজস্বিনী রূপে উপস্থিতিতে উনকোটির মানুষজন বিহ্বল হয়ে পড়ল। একটি কচি পাঁঠা দড়িতে বাঁধা – এক মনে কাঁঠালপাতা চিবুচ্ছিল। বধূটি বলল, মা ওই ছাগশিশুর রক্ত চেয়েছে? মা কাকে এ কথা বলেছে? মা শুধু তোদের মা? মা জগৎ সংসার সকলের মা। মা এই ছাগলছানারও মা। শোন সকলে, এই পুজো বন্ধ কর। শনিবার নতুন করে পুজো হোক। আর বলিদানও এখন থেকে বন্ধ। সকলে শিরোধার্য করে নিল সেই নির্দেশ। বধূটির কথামতো পরের শনিবারই ফের পুজো হল। বধূটি সে দিন বলিস্থানে একটি ত্রিশূল পুঁতে দিল। সেই জায়গায় আজও একটি ত্রিশূল বিরাজমান। এই ঘটনা প্রায় পঁচাত্তর বছর আগের। সে দিন অশিক্ষিতা এক বধূর গলায় ‘বিসর্জন’ নাটকের গোবিন্দমাণিক্যের সংলাপ শুনে অনেকেই হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। অথচ বধূটি গ্রামেরই রাধানগর পাড়ার বাগেদের বাড়ির বউ। পরবর্তী কালে ওঁকে আমরা সাধিকা রূপে দেখেছি। স্বল্পবাক প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী এক মহিলা। দেখলেই সম্ভ্রমে মাথা নত হয়। অসুস্থ কেউ তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনি বলতেন, আমি ডাক্তার নই। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাও। অথচ দেখেছি, অনেকে অযাচিত ভাবে তাঁর কৃপা লাভ করেছে। তাঁদের পাড়ায় ছিল তাঁর সাধনক্ষেত্র। তাঁর অন্তর্ধানের পর সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। এখনও বহু লোক সেখানে পুজো দিয়ে তাঁর চরণে প্রণাম জানায়। ছবি: আইভি দে ]]>
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।