প্রসিত দাস
এটা অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ। এই অক্টোবর বিপ্লব বা রুশ বিপ্লবকে সব চেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল কোন বই? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই নিজেদের মতো তালিকা জোগাবেন। কিন্তু যদি বলি কোন উপন্যাস? এখানেও কি দাবিদার কম নাকি? কিন্তু খোদ লেনিনকে প্রবল নাড়া দিয়েছিল যে উপন্যাস তার তো একটা জোরালো দাবি থাকতেই পারে। লেনিনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক রচনা ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’ প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে। এই বইয়ের শিরোনামটা তিনি নিয়েছিলেন নিকোলাই চেরনিশেভস্কি-র ওই একই নামের উপন্যাস থেকে।
লেখক, সম্পাদক, সাহিত্য সমালোচক ও সমাজতন্ত্রী নিকোলাই চেরনিশেভস্কি ১৮৬২ সালে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের দায়ে গ্রেফতার হন। তাঁকে বিনা বিচারে টানা দু’ বছর সেন্ট পিটার্সবুর্গের নিজস্ব বাস্তিল পিটার-পল দুর্গে আটক রাখা হয়। এর পর জার-শাসিত রাষ্ট্র তাঁকে সাইবেরিয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেয়। কুড়ি বছর বছর পর যখন ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে মুক্তি পান তখন তাঁর মৃত্যুর আর বেশি দেরি নেই। ১৮৬২-৬৪ এই দু’ বছরে পিটার-পল দুর্গে বসে চেরনিশেভস্কি যা-যা লেখেন তার মধ্যে ছিল একটা উপন্যাসও, নাম ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান? টেলস অফ নিউ পিপল’।
এই উপন্যাস তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার মাধ্যম, সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন যে সরাসরি রাজনৈতিক কিছু লেখার বদলে উপন্যাস লিখলে সেন্সরের রক্তচক্ষু এড়ানো সহজ হবে। হয়েছিলও তাই, তবে একদম অন্য ভাবে। এ বইয়ের পাঠকসমক্ষে আসার কাহিনি কোনো রুশ উপন্যাসের কাহিনির থেকে কম চমকপ্রদ নয়। প্রথমে এই উপন্যাসের পান্ডুলিপি পাঠানো হয় জেল কর্তৃপক্ষের কাছে, তার পর সেখান থেকে চেরনিশেভস্কির মামলার জন্য বিশেষ ভাবে গঠিত তদন্ত কমিশনের কাছে। এই দু’ জায়গায় এই পান্ডুলিপিতে এত সরকারি শীলমোহরের ছাপ মারা হয় যে সেটা যখন সেন্সরের দফতরে গিয়ে পৌঁছোয় তখন তারা ভাবে এই পান্ডুলিপি বোধহয় ইতিমধ্যেই ছাড়পত্রপ্রাপ্ত, তারা আর উপন্যাসটা পড়েও দেখে না। এর পর এই পান্ডুলিপি পাঠানো হয় চেরনিশেভস্কির বন্ধু কবি ও সম্পাদক নিকোলাই নেক্রাসভের কাছে, আর তিনি সেটা হারিয়ে ফেলেন পিটার্সবুর্গের প্রাণকেন্দ্র নেভস্কি প্রসপেক্টে। শেষমেশ নেক্রাসভ পুলিশ গেজেট-এ বিজ্ঞাপন দিলে এক সরকারি কেরানি তাঁর কাছে এসে পান্ডুলিপি ফেরত দিয়ে যান। এত কাণ্ডের পর ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’।
এই উপন্যাসের কাহিনি খুব চমকপ্রদ কিছু নয়। ১৮৫০-এর দশকের পিটার্সবুর্গে বাবা-মা-র সঙ্গে থাকে ভেরা। তার মা তার বিয়ে দিতে চায় সেনাবাহিনীর এক লম্পট অফিসারের সঙ্গে। তরুণ ডাক্তারির ছাত্র লোপুকভের সাহায্যে ভেরা পালায়। তারা একসাথে থাকতে শুরু করে। আরও পাঁচ জন তরুণীকে নিয়ে ভেরা গড়ে তোলে জামাকাপড় সেলাইয়ের এক সমবায়। এরই মধ্যে ভেরা লোপুকভের প্রিয় বন্ধু কিরসানভের প্রেমে পড়ে। এখান থেকে এই উপন্যাস হয়ে ওঠে ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি। লোপুকভ ও ভেরার জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য কিরসানভ একটা সাজানো আত্মহত্যার ঘটনা মঞ্চস্থ করে ও মার্কিন মুলুকে চলে যায়। তাকে সাহায্য করে রাখমেতভ নামে এক রহস্যময় ব্যক্তি। পরে অবশ্য সে রাশিয়ায় ফিরে আসে অন্য নামে, বিয়েও করে।
উপন্যাসের শেষে আমরা ভেরা ও কিরসানভকে সুখী দম্পতি হিসেবে দেখি। এই উপন্যাসের আঙ্গিক কিছুটা খাপছাড়া, এখানে ভূমিকা আসে প্রথম দু’টো অধ্যায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর। মাঝেমাঝেই আখ্যানের গতিকে থামিয়ে দিয়ে চরিত্রদের কার্যকলাপ নিয়ে পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন লেখক স্বয়ং। এ ছাড়া এই উপন্যাসে সংযোজিত হয়েছে ভেরার চারটে স্বপ্নদৃশ্য, তার মধ্যে শেষটা যেন এক সমাজতান্ত্রিক ইউটোপিয়ার ছবি।
প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’ সমালোচকদের কোপে পড়ে। তুর্গেনিভ ও তলস্তয়ের মতো রুশ সাহিত্যের মহারথীরা কাহিনি ও প্লটের দুর্বলতার জন্য এই উপন্যাসের উপর খড়্গহস্ত হন। তুর্গেনিভ চেরনিশেভস্কিকে বলেন ‘নগ্ন ও দন্তহীন এক বৃদ্ধ যিনি শিশুদের মতো আধোআধো করে কথা বলেন’। এই উপন্যাসের ভাবনার বিরোধিতা করার জন্য দস্তয়েভস্কি লিখে ফেলেন একটা আস্ত উপন্যাস, ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’।
কিন্তু এই সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় প্রকাশের পরবর্তী তিন দশক জুড়ে রুশ তরুণদের মধ্যে ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’-এর অদম্য প্রভাব। উপন্যাসের রাখমেতভের মধ্যে এক নৈরাজ্যবাদী সমাজতন্ত্রীকে চিনে নিতে তারা ভুল করেনি। তার এবং এই উপন্যাসের অন্য পাত্রপাত্রীদের ছাঁচে অনেকেই নিজেদের জীবনকে ঢেলে সাজায়। এখানে কয়েকটা বিখ্যাত উদাহরণ তুলে দিচ্ছি, অজানা উদাহরণ আরও অনেক।
“দার্শনিক বস্তুবাদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচিতির জন্য আমি চেরনিশেভস্কির কাছে ঋণী।… আমি চেরনিশেভস্কি পড়েছি হাতে পেনসিল নিয়ে, নোট নিয়ে গেছি… মার্কস, এঙ্গেলস ও প্লেখানভের লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে আমার উপর বিরাট প্রভাব ছিল একমাত্র চেরনিশেভস্কিরই, সে প্রভাব অদম্য” – ভ্লাদিমির লেনিন
‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’ প্রকাশিত হওয়ার দু’ বছরের মধ্যেই ভেরা জাসুলিচ উপন্যাসের ভেরার মতোই বই বাঁধাইয়ের একটা সমবায়ে কাজ করতে শুরু করেন, তাঁর মা ও বোনেরা জামাকাপড় সেলাইয়ের এক সমবায়ে যোগ দেন। রাখমেতভের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত নিকোলাই ইশুতিন গড়ে তোলেন এক বিপ্লবী গোষ্ঠী। আর তাঁর তুতো ভাই কারাকাজভ জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে হত্যার চেষ্টা করেন, তাঁর ফাঁসির সাজা হয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’-এর মাঝপথে রাখমেতভ হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, লেখক আমাদের জানান তিন বছর পর সঠিক সময় সে আবার উদয় হবে। আর ইশুতিন ও কারাকাজভ তাঁদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের তারিখ হিসেবে বেছে নেন ৪ এপ্রিল, ১৮৬৬ দিনটা -– অর্থাৎ ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’ প্রকাশিত হওয়ার ঠিক তিন বছর পরের তারিখ। লক্ষ করুন, এখানে সাহিত্য জীবনের নয়, জীবন সাহিত্যের অনুকরণ করছে।
লেনিনের দাদা চরমপন্থী বিপ্লবী আলেকজান্ডার উলিয়ানভকেও এই উপন্যাস গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনিও জারকে হত্যা করার ছক কষেছিলেন। জেলে তাঁর মৃত্যুর পর লেনিন পড়তে শুরু করেন এই উপন্যাস। আর ঠিক কত দূর প্রভাবিত হন সেটা শোনা যাক তাঁর জবানিতেইঃ “দার্শনিক বস্তুবাদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচিতির জন্য আমি চেরনিশেভস্কির কাছে ঋণী।… আমি চেরনিশেভস্কি পড়েছি হাতে পেনসিল নিয়ে, নোট নিয়ে গেছি… মার্কস, এঙ্গেলস ও প্লেখানভের লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে আমার উপর বিরাট প্রভাব ছিল একমাত্র চেরনিশেভস্কিরই, সে প্রভাব অদম্য।”
‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’ নিয়ে এই মুগ্ধতা তাঁর পরিণত বয়সেও কাটেনি। তাই নিজের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক রচনার নাম দেওয়ার সময় হাত পেতেছিলেন অন্যতম প্রিয় উপন্যাসের কাছে। প্লেখানভ বলেছেন ছাপাখানা আসার পর থেকে রুশ দেশে প্রকাশিত সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’। হয়তো অতিশয়োক্তি, কিন্তু এই ‘নতুন মানুষদের কাহিনি’ সাহিত্যমূল্যের প্রশ্নকে ছাপিয়ে রুশ তরুণদের কয়েক প্রজন্মকে যে ভাবে প্রভাবিত করেছিল তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে কমই পাওয়া যায়।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।