সন্তোষ সেন
পৃথিবী থেকে মহাকাশটা কে খুব সুন্দর লাগে, তাই না? আস্তেরিক্স কমিক্স-এর ভিস্তালাস্তাতিতিক্স চরিত্রটির কথা মনে পড়ছে? যে সব সময় ভয় পেত এই বুঝি আকাশটা ওর মাথায় ভেঙে পড়বে। এই আশঙ্কা এখন আমাদের পেয়ে বসেছে। আকাশটা ভেঙে না পড়লেও মহাকাশে মানুষের পাঠানো হাজার হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ, মহাকাশযান-রকেট, ছোটো বড়ো কয়েক হাজার টুকরো জঞ্জাল, সত্যি সত্যি যে কোনো সময় আমাদের মাথায় ভেঙে পড়ত পারে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে চিনের স্পেসল্যাব টিয়ানগং – ১ যে কোনো সময় পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে ভেঙে পড়তে পারে। অবাক হবেন না। এর আগে নাসার স্কাইল্যাব স্কাইল্যাব ও রাশিয়ার স্যালিউট মহাকাশযান কিন্তু সত্যি সত্যি পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিল।
তথ্য কী বলছে দেখা যাক। নাসার হিসেব অনুসারে ২০১৪ সালে আট হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে পরিক্রমণ করছে, যাদের অধিকাংশের কর্মক্ষমতা শেষ। কারণ কৃত্রিম উপগ্রহগুলো কাজ করতে পারে খুব বেশি হলে ১০ থেকে ১২ বছর, যদি না যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তার আগেই বাতিল হয়ে যায়। শুধু কী তাই? হিসেব বলছে – মহাকাশে এক থেকে দশ সেন্টিমিটার ব্যাসের প্রায় পাঁচ লক্ষ উপগ্রহ-টুকরো এবং দশ সেন্টিমিটারের বেশি ব্যাসের একুশ হাজার উপগ্রহ-টুকরো দ্রুত গতিতে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। শুনলে অবাক হবেন, ২০০৯ সালে রাশিয়ার একটি সামরিক উপগ্রহ ও তাদের চিরশত্রু আমেরিকার একটি যোগাযোগ উপগ্রহের মধ্যে সংঘর্ষে ছোটো-বড়ো কয়েক হাজার টুকরো ভগ্নাবশেষ সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এই সুন্দর মহাকাশে।
আরও পড়ুন: কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পৃথিবীতে ভেঙে পড়বে চিনা মহাকাশ স্টেশন
মহাকাশে সব চেয়ে বেশি জঞ্জাল জমা করেছে রাশিয়া, আমেরিকা, চিন এবং ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশ। তাই মহাকাশকে জঞ্জালমুক্ত করার দায়িত্বটা তাদেরই সব চেয়ে বেশি। কাজ শেষ করার আগে কৃত্রিম উপগ্রহগুলোকে যদি সেকেন্ডে মোটামুটি এগারো কিমি বেগে ৩৬০০০ কিমি উপরে তুলে দেওয়া যায়, তা হলে সমস্যার কিছুটা সুরাহা হয়। এটা করতে হলে সরকার বা কোম্পানিগুলোকে উপগ্রহ পিছু ১০ থেকে ৩০ কোটি টাকার মতো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। তাই আজ পর্যন্ত মহাকাশে জঞ্জাল সাফাই করার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে উঠল না। অন্য দিকে অকেজো উপগ্রহগুলোকে পরিষ্কার করার ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করে গজিয়ে উঠছে নতুন অর্থনীতি। আমেরিকা ও চিন মহাকাশে পাঠাতে শুরু করেছে অ্যান্টি স্যাটেলাইট। এই অ্যান্টি স্যাটেলাইট অকেজো উপগ্রহগুলোর বুক বিদীর্ণ করে তাদের হাজার হাজার টুকরো করে মহাকাশে ছড়িয়ে দিবে।

এই বিষয়ে বিজ্ঞানীরা কী বলছেন? আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন) তথা আইডিএ-র একজন বরিষ্ঠ গবেষক ডক্টর ভাব্য লাল জানিয়েছেন, “অ্যান্টি স্যাটেলাইট বাণিজ্য নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত। ২০০৭ সালে চিনের অ্যান্টি স্যাটেলাইট অকেজো উপগ্রহগুলো ভেঙে তিন হাজার ছোটো টুকরো এবং প্রায় পাঁচ লক্ষ বড়ো টুকরো মহাকাশে মিশিয়ে দিয়েছে।”
খুব উদ্বেগের বিষয় হল – পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক হাজার কিমি উপরে বিভিন্ন উপগ্রহের পেটে তিরিশটির মতো অকেজো পরমাণু রিঅ্যাক্টর ও তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ (রেডিও আইসোটোপ) দ্বারা চালিত দশটি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র রয়ে গিয়েছে। ভাবতে পারছেন, এই তেজস্ক্রিয় শাক্তির অকেজো উৎসগুলি কী পরিমাণ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়াচ্ছে মহাকাশ জুড়ে? অতি তীব্র বেগে ঘূর্ণায়মান টুকরোগুলো যেমন মহাকাশের দূষণ ঘটাচ্ছে, তেমনই এগুলো উপগ্রহের কার্যক্ষমতাও নষ্ট করছে, দেখা দিচ্ছে যান্ত্রিক ত্রুটিবিচ্যুতি।
৩৬ হাজার কিলোমিটার উপরে যোগাযোগ উপগ্রহগুলোকে (কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট) কে প্রথমে তিন ডিগ্রি কোণের ব্যবধানে প্রতিস্থাপন করা হত, যাতে হিসেবমতো সর্বাধিক ১২০টি উপগ্রহ পাঠানো যায়। কিন্তু বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে যোগাযোগ উপগ্রহ (২৫০টিরও বেশি) ভূসমলয় কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করার ফলে উপগ্রহগুলোর মধ্যে কৌণিক দূরত্ব কমে দু’ ডিগ্রি, কোথাও আবার মাত্র এক ডিগ্রিতে পৌঁছেছে। ঘটনাটি সত্যিই খুব উদ্বেগের।
হাজার লক্ষ মহাকাশ-জঞ্জাল যে কোনো সময় মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই এই বলে এই ছোটো নিবন্ধটি শেষ করব—জঞ্জাল নয়, মহাকাশ দূষণ নয়, মহাকাশ বাণিজ্য নয়। দাওয়া ফিরিয়ে আমাদের মুক্ত স্বচ্ছ মহাকাশ। বিজ্ঞানর জয়রথ চলুক, কিন্তু মহাকাশ গবেষণার জয়যাত্রা মানুষের সত্যিকারের কল্যাণে লাগুক।
(লেখক কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক)
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।