স্মিতা দাস
বহুর বহু আশা। বইমেলায় কেউ যায় বই কিনতে। কেউ কেবলই বই দেখতে। কেউ বই ঘাঁটতে। কেউ বা শুধুই ঘুরতে। আবার কেউ যায় মিষ্টি আলাপে একটা বেলা কাটিয়ে দিতে। কিন্তু বইমেলায় শুধু তো বই-ই নয়, আছে অন্য অনেক কিছু। কিন্তু কেন, কী কারণে এমন বিচিত্র সব পণ্যের আয়োজন কলকাতা বইমেলায় ? কারও উদ্দেশ্য নিছকই পেটের রুজি জোগাড় করা, কারও বা উদ্দেশ্য আরও বড় বাজার ধরা, কেউ বা বাজিয়ে দেখছেন কিছু করে পকেটমানি জোগাড় করা যায় কিনা, অনেকে আবার নিজের ক্রিয়েটিভিটি ঝালিয়ে নিচ্ছেন।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে এমন এক সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল যারা গরিব, অত্যাচারিত, ধর্মীয় অহিষ্ণুতার দরুন নিপীড়িত, রাজনৈতিক টানাপোড়েনের দরুন ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য মেলায় এসেছেন। তাঁরা বসেছেন তাঁদের হস্তশিল্পের সম্ভার নিয়ে। কাঠের তৈরি নানা আর্টফর্ম। কথা হচ্ছিল ‘আমরা’ নামের ওই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিবাদী সংগঠনের অন্যতম সদস্যা উল্টোডাঙার টুম্পা মণ্ডলের সঙ্গে। টুম্পা জানান, “ন’ বছর ধরে আমরা এর সঙ্গে যুক্ত। যেখানে মানুষের ওপর অত্যাচার হয়, হাঙ্গামা হয়, আমরা সেখানে গিয়ে ফিল্ড সার্ভে করি, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং করি। সেই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং-এর জন্য আমাদের যে আর্থিক সাপোর্টটা দরকার সেই সাপোর্টের জন্য আমরা ক্রাফটটাকে ইউজ করি। এর পাশাপাশি আমরা নিপীড়িতদেরও আর্থিক সাহায্য করি। এই সব সামগ্রী বিক্রি করে যে ফান্ডটা আমরা পাব তা আমরা ‘আমরা’র কাজে লাগাব।”
মেলায় এসেছেন সালকিয়ার রাজকুমার মণ্ডল। নানা ধরনের কাগজ জলে ভিজিয়ে রেখে কী ভাবে একটা শক্ত অথচ হাল্কা পদার্থ তৈরি করা যায় এবং সেই পদার্থ দিয়ে কী ভাবে নানা মুর্তি বানানো যায়, তার উপায় বের করেছেন রাজকুমার। আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে নিজের মস্তিষ্কজাত সেই সব সন্তানকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসতে বইমেলার ভূমিকেই বেছে নিয়েছেন। জানালেন, “বইমেলায় অনেক বন্ধু হয়ে গেছে। গত পাঁচ-ছ’ বছর ধরে আসি। তাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় আর এখান থেকে যা ইনকাম হয় তা আবার এই কাজেই ব্যয় করি। আমি অন্য প্রফেশনে আছি। কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পর যেটুকু অবসর থাকে, সেই সময়টায় আমি এই কাজটা করি। বইমেলার জন্য প্রস্তুতি নিই।”
খড়দা থেকে আসা কন্টেণ্ট ‘ম্যানেজার অ্যান্ড এডিটর’ অদিতির গোষ্ঠী আবার নিজেদের একটা আলাদা গন্ধ দিতে মেলার বুকে ছোটদের প্রিয় মিকি-মিনি, টম-জেরি, বড়দের প্রিয় চার্লি চ্যাপলিন থেকে শুরু করে আধুনিকা বার্বি মডেল বা যুবক-যুবতীদের পচ্ছন্দের নানা থিমে রাঙানো কুর্তি আর টি-শার্টের সম্ভার সাজিয়ে বসেছেন। অদিতি জানালেন, “আমরা কেউ অদিতি, কেউ অভিষেক, কেউ বা অরিত্র কিংবা পিউ। আমাদের ক্রিয়েটিভিটি দিয়েই আমাদের একটা আইডেন্টিটি তৈরি হবে। এখানে এসে খুব ভালো সাড়া পেয়েছি। এর থেকে বুটিক খোলার পরিকল্পনা মাথায় পরিপূর্ণ ভাবে আছে।” যখন জামাকাপড়ের কথায় এসেই গেল তা হলে আর অলংকার সামগ্রীই বা বাদ পড়ে কেন? তা-ও আছে। মনভোলানো ডিজাইনের কান-গলা–হাতের গয়না। মেটিরিয়াল খুব সাধারণ। মাটি, কাঠ, ধান, রঙ, সুতো, রঙিন পুঁতি ইত্যাদি। সাধারণ হলেও এ সবের গয়না অন্য যে কোনও মেটিরিয়ালের তৈরি গয়নার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারে। ওই দোকানের ভিড় বইমেলার বইয়ের স্টলগুলোর জনপ্রিয়তাকেও ম্লান করে দিয়েছে এক কথায়।
বইমেলা শুধু তো বইয়ের মেলা নয়। দেশ-দেশান্তর, রাজ্য-রাজ্যান্তর থেকে কেবল লেখক-প্রকাশকরাই আসেন না, আসেন চিত্রশিল্পীরাও। যেমন এসেছেন প্রতিবেশী বিহারের জিতওয়ারপুর থেকে রাজ্য পুরস্কার প্রাপ্ত মধুবনী মিথিলা ঘরানার মহিয়সী মায়ের সুপুত্র মহোদয় ঝাঁ, তাঁদের রকমারি স্টাইলের চিত্রকলা নিয়ে। উদ্দেশ্য, পুরনো যোগাযোগগুলো ঝালিয়ে নিয়ে আরও প্রচার পাওয়া, আরও নতুন নতুন সৃষ্টি-সম্ভার গুণগ্রাহীদের উপহার দেওয়া। কলকাতার বিভিন্ন পুজো-প্যাণ্ডেলে তাঁদের ঘরানার চিত্রকলা দেখা পাওয়া যায় বলেও তাঁরা জানান। মহোদয়বাবু জানালেন তাঁরা কলকাতায় কবে কোথায় ‘পান্ডালের’ কাজ করেছেন। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড থেকে বাগুইহাটি, সোদপুর থেকে কাঁকুড়গাছি –- কোথায় কাজ করেননি মহোদয় ঝাঁ! বেশ কয়েক বছর ধরে তাঁরা কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় পুজোয় কাজ করছেন। প্যান্ডেল সাজানোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম যে কেবল প্রতিবেশী রাজ্যের চিত্র-ঘরানা তা তো নয়, নিজের রাজ্যের শিল্পীরাই বা বাদ পড়বেন কেন? তাঁরাও আছেন এই বইমেলায়। এসেছেন পটচিত্র শিল্পীদের প্রায় ষাট জনের একটা দল, যাঁরা সারা বইমেলা জুড়ে ছড়িয়ে আছেন রঙিন পটচিত্রে আঁকা হাতি-ঘোড়া-শিব-পার্বতীর নানা কাহিনি নিয়ে, জানালেন নয়াগ্রাম-পিংলা থেকে আসা মধু চিত্রকর। তাঁর কাছ থেকেই জানা যায়, প্রথমে তাঁরা কেবল পৌরাণিক গল্পকাহিনিই পটচিত্রে ফোটাতেন। কিন্তু এখন যুগের সঙ্গে পাল্লা দিতে ফরমায়েশি বিষয় নিয়েও কাজ করছেন। এমনকী এখন মনকাড়া ড্রেস মেটিরিয়াল, ঘর সাজানোর জিনিসেও পটচিত্রের ব্যবহার চলছে এবং তা বাজারে হৈ হৈ করে বিকোচ্ছে। মধু চিত্রকর বললেন, “একটু একটু করে পালটে দিয়েছি বিষয়গুলো। যেমন এখন পরিবেশ দূষণ, নারী নির্যাতন, শিক্ষাশ্রী, কন্যাশ্রী ইত্যাদি নিয়ে পট বানাচ্ছি। আবার পটের পুরনো বিষয়গুলো বিভিন্ন জিনিসের ওপর আঁকছি। যেমন জামা, শাড়ি, কুর্তি, টি শার্ট, ব্যাগ, ঘর সাজানোর জিনিস, পাখা, কুলদানি এ সব।” শুধু পণ্য বেচাই নয়, এঁদের বইমেলায় আসার অন্য উদ্দেশ্যও আছে। সেটা হল ‘বড়’ বাজার ধরা। পুজো-প্যাণ্ডেলের অঙ্গসজ্জার বায়না পাওয়া, বিদেশি কাস্টমারদের অর্ডার পাওয়ার মাধ্যম হল এই বহু প্রতীক্ষিত বইমেলা। বছরের বাকি সময়টা জীবনযাপনের তাগিদে কেউ নিজের কেউ বা পরের মাঠে চাষের কাজ করলেও এই সময়টায় বইমেলায় আসা থেকে কেউ তাঁদের আটকাতে পারে না।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ে যায় বেশ কিছু স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দিকে যাঁরা নিজেদের আরও স্বনির্ভর করতে বইমেলাকে অবলম্বন করেছেন। আছে বেশ কিছু পাটজাতদ্রব্য, ব্যাগ, ঘর সাজানোর জিনিস, নানা দরকারি-অদরকারি জিনিসের ছোট-বড় হরেক কালেকশন। বারুইপুরের মালঞ্চ থেকে এসেছেন পুরস্কারপ্রাপ্ত টেরাকোটা শিল্পীর স্ত্রী মালবিকা অধিকারী। বিয়ের পর স্বামীর সখ ও পেশাকে নিজের করে নিয়েছেন মালবিকা। তিনি জানান, “গত বছর আমার স্বামী দু’টো পুরস্কার পেয়েছেন, রাজ্য ও জেলা স্তরে। একটায় প্রথম আর একটায় দ্বিতীয়। মেলায় ভালোই সাড়া পাচ্ছি।” বেলঘরিয়ার দেবাশিস চন্দ্রও বাদ যাননি। ঘর সাজানোর স্বহস্ত-নির্মিত কাঠের সামগ্রী সাজিয়ে বসেছেন মিলনমেলা প্রাঙ্গণে। দিঘার বাসিন্দা উষারঞ্জন মণ্ডল উপস্থিত তাঁর নিজের শৈলীর ডট পেণ্টস নিয়ে। তিনি জানান “আমার যে হেতু ড্রয়িং ভালো লাগে তাই ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং করার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তাতে মনে হল, আমার লাইনটা আটকে যাচ্ছে। দু’ সপ্তাহ আগে একটা শো ছিল। সেখানে তিনটে ছবি বিক্রি হয়েছে। একটা গেল সিডনি, একটা মুম্বই, আর একটা বিক্রি হয়েছে দিল্লিতে। আগামী ৯ তারিখে আমার দু’টো পেন্টিং-র অকশন আছে টাটা স্টিলের আর্টক্যাম্পে।”
কেউ বা আঁকছেন কেবলই স্কেচ। ছবি আঁকিয়েদের ভিড়ে দেখা গেল কোনও দিনও আঁকার স্কুলের মুখ-না-দেখা অবাঙালি যুবক সনু চৌরাসিয়াকে। বইমেলায় ঘুরতে এসে বাকি শিল্পীদের দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে কেবলমাত্র দু’টি চেয়ার, কিছু আর্টপেপার নিয়ে বসে পড়েছেন। উডপেন্সিলের টানে নিজের পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে পাকা হাতের সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশের সনু জানান “ম্যাঁয় তো অভি বি টেক পড় রহা হুঁ। ইধর পে ম্যাঁয় ঘুমনে আয়া থা। তো ম্যাঁয় নে সোচা কি ম্যাঁয় ভি বৈঠ যাতা হুঁ। মেরা ভি পকেটমানি নিকাল জায়েগা। লোন লিয়া পড়নে কে লিয়ে। দো দিন মে মেরা টু থাউজেন্ড হো গিয়া হ্যায়। ইয়ে মেরা ফার্স্ট টাইম হ্যায়, অওর উহ ভি কলকাতা মে।”
আলাপ হয়ে গেল পিকনিক গার্ডেনের প্রবীর দত্তের সঙ্গে। রঙবেরঙের নানা কাগজের টুকরো দিয়ে অবিরাম বানিয়ে চলেছেন নানান কোলাজ। যেমন রঙিন তেমন অভিনব। তিনি জানান, তিনি আর্টের অনেক কাজ করেন, তবে কাগজ দিয়ে কাজটা তাঁর বেশি ভালো লাগে। কাগজের কোলাজ ওঁর খুব প্রিয়।এ ছাড়া প্রিন্টিং-এরও কাজ করি। ডাল, মশলাদানা দিয়ে যে কাজগুলো হয় সে কাজও করেন। তিনি জানালেন, “বইমেলা কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় তিনি খুশি। আলোর সমস্যা ছিল। ওঁরা আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি।” ওঁর সামনের ভিড় প্রমাণ করল যে ওই কাগজ-কাটা কোলাজে অদ্ভুত রঙের মিশেল যেন অনন্য।
আর একটা বিষয় গান। মেলাপ্রাঙ্গণ মানেই গান। থাকবেই থাকবে। সে যে ভাবেই হোক। তেমনই এক জনের দেখা মিলল। যাঁর কণ্ঠ বেশ খানিকটা দূর থেকেও শ্রোতাদের কানে ঢুকছে আর মুখরিত হছে মেলাপ্রাঙ্গণের খানিকটা।
বই তো কেবল বই না। বই একটা শিল্প। শিল্প ডেকে আনে অন্য শিল্পকে। তাই মিলনমেলা প্রাঙ্গণে ঘুরতে ঘুরতে একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখা মেলে এমন বহু শিল্পী আর শিল্পের। যা মেলাকে যেমন বৈচিত্র দেয় তেমনই শিল্পীকে দেয় পরিসর, দেয় পরিচিতি। বহু শিল্পীর রুজির জোগাড় করে বইমেলা। বইমেলায় বই তো চাই-ই চাই। সঙ্গে হোক না, স্বাদ বদল।
ছবিঃ লেখিকা
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।