শ্রয়ণ সেন ঋভু
বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে দুই বাংলার মধ্যে যে প্রীতির সম্পর্ক আছে, এই বইমেলার মাধ্যমে তা আরও জোরদার হবে বলে আশা করেন ‘বাংলা একাডেমি’র পরিচালক ড. জালাল আহমেদ।
গত বছরগুলোর মতো এ বারের বইমেলাতেও বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে প্রতি দিনই লোক উপচে পড়েছে। প্যাভিলিয়নে প্রতি স্টলের সামনে বেশ ভিড়। বিক্রিবাটাও ভালোই হয়েছে বলে জানালেন বেশ কিছু বিক্রেতা। প্যাভিলিয়নে ঢোকার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়েছে রোজ। আগ্রহী মানুষজন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন, কখন বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে ঢোকার সুযোগ পাবেন। কেন এত আগ্রহ ?
৪০তম কলকাতা বইমেলার শেষ দিনে এই প্রশ্ন নিয়েই হাজির হয়েছিলাম ড. আহমেদের কাছে। তাঁর মতে, এই আগ্রহের মূলে রয়েছে ভাষা। একই ভাষার শরিক আমরা। দুই বাংলার মধ্যে শক্তিশালী ভাষা-প্রীতি রয়েছে। এই জন্যই বাংলাদেশের বই সম্পর্কে বিপুল আগ্রহ পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের মধ্যে, পাঠকদের মধ্যে রয়েছে। আর এই আগ্রহের জন্যই পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের বইয়ের ব্যাপক চাহিদা আছে। এবং এই চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছে। এ বারের বইমেলায় বাংলাদেশের ৩২ জন প্রকাশক যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে ৫টি সরকারি প্রকাশনা সংস্থাও রয়েছে।
উল্লেখ্য, ড. জালাল আহমেদ অমর একুশে গ্রন্থমেলা’১৬-এর সদস্য সচিবও। কথায় কথায় ড. আহমেদ জানালেন, বাংলাদেশের প্রকাশকরা বিভিন্ন ধরনের সৃষ্টিশীল বই নিয়ে মেলায় এসেছেন। এর মধ্যে অভিধানধর্মী, গবেষণাধর্মী বই আছে। এ ছাড়া আছে বাংলা ভাষা সংক্রান্ত বই, সাহিত্যের বই, শিশু-কিশোরদের উপযোগী বই। ‘বাংলা একাডেমি’-এর তরফ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে নজরুল রচনাবলি, রবীন্দ্রনাথের উপর বই, বিশ্বের বিভিন্ন ক্লাসিক সাহিত্যের অনুবাদ, বাংলা অভিধান ইত্যাদি।
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের গবেষণাধর্মী বিভিন্ন পত্রপত্রিকার চাহিদা আছে বলে জানালেন ড. আহমেদ। এর মধ্যে ‘উত্তরাধিকার’ নামে পত্রিকাটি এ বঙ্গে বেশ চলে বলে মত প্রকাশ করলেন তিনি। ড. আহমেদের আশা, বাংলা-ভারত যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান চলে, কলকাতা বইমেলাকে কেন্দ্র করে তা আরও জোরদার হবে। বইমেলাকে ঘিরে দুই দেশের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন হয়, ভবিষ্যতে তা আরও শক্তপোক্ত হবে।
‘অবসর’-এর স্টলের সামনে আলাপ হল চন্দননগর থেকে আসা সৌম্যদীপ্ত সরকারের সঙ্গে। তিনি মুস্তাফিজ মামুনের ‘দেখুন বাংলাদেশ’ বইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। জানতে চাইলাম, বাংলাদেশে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে কিনা। তাঁর কথায়, “বেড়াতে কবে যাব জানি না। তবে এই বইটায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য রয়েছে। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। মানে, বেড়াতে না গিয়েও ঘরে বসেই দেশটাকে অনেকটা চেনা হয়ে যায়। তা ছাড়া কী ভাবে যাব, কোথায় থাকব, প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা আছে কিনা, বেড়াতে গিয়ে কী সতর্কতা নিতে হবে ইত্যাদি খুঁটিনাটি তথ্য তো আছেই। কিন্তু দামটা বেশ বেশি। তাই অনেকক্ষণ ধরে ইতস্তত করছি।” তবে কোনও রকম ইতস্তত না করেই হুমায়ূন আহমেদের ‘গল্পসমগ্র’ কিনে নিয়েছেন উত্তর কলকাতার শ্রাবন্তী সান্যাল। বড়িশার বিবেকের হাতে ধরা এম আর আখতার মুকুলের “একুশের দলিল’ প্রমাণ করল সেই ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন নিয়ে এ বঙ্গের এই প্রজন্মের ছেলেপুলেদেরও যথেষ্ট আগ্রহ আছে।
এ বার বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন তৈরি হয়েছে ঢাকার বর্ধমান হাউস-এর আদলে। ১৯০৫ সালে যখন ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ঢাকার রমনার মাঠে সরকারি দফতর ও সরকারি কর্মীদের থাকার জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরি হয়। তার মধ্যে একটি হল বর্ধমান হাউস। এটি ১৯০৬ সালে নির্মিত। অবিভক্ত বাংলার গভর্নরের শাসন পরিষদের সদস্য বর্ধমান মহারাজ বিজয়চাঁদ মহতাব ঢাকায় এলে এই বাড়িতে থাকতেন বলে এই বাড়িটির নাম হয় বর্ধমান হাউস।
এ বারের বইমেলায় বেশ নজর কেড়েছিল ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাবের স্টলটি। প্রায় প্রতি দিন এঁদের স্টলে বেশ ভিড় হয়েছে। সাংবাদিকতার ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও গবেষকদের সুবিধার জন্য এঁরা বিভিন্ন প্রকাশকের সাংবাদিকতা, জনসংযোগ, গণজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্র, খেলা ইত্যাদি বিষয়ক বই নিয়ে মেলায় বসেন। কথা হচ্ছিল ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রাহুল গোস্বামীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, সাংবাদিকতার টেক্সট বই ছাড়াও যুগপৎ সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের আগ্রহ আছে এমন ‘অন্য ধরনের’ বইয়ের সম্ভারও রয়েছে তাঁদের স্টলে। ‘অন্য ধরনের’ বই বলতে কী বোঝায় জানতে চাইলে আমাকে নিজেই ঘুরে দেখে নিতে বললেন। দেখলাম, রয়েছে ‘কলকাতা’ সংক্রান্ত বইয়ের বিপুল সম্ভার। রয়েছে বাংলা ভাষা, বাংলা বানান, ভ্রমণ, আত্মজীবনী, পরিবেশ, শরীর-স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ক বই-ও। রাহুলবাবু জানালেন, ১৯৯৩ সাল থেকে তাঁরা বইমেলায় আসছেন। সে দিকে দেখতে গেলে আগামী বইমেলায় তাঁদের মেলায় আসার ২৫ বছর পূর্ণ হবে। প্রথমে ১০০ বর্গফুটের স্টল দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁদের যাত্রা। সেখান থেকে ২০০, তার পরে ৪০০ বর্গফুট। এ বছর তাঁরা ভালো সাড়া পেয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরও জানালেন, ক্লাবের মুখপাত্র ‘সাংবাদিক’ বছরে তিনটি করে প্রকাশিত হয়। এ বারের বইমেলায় ‘সাংবাদিক’-এর যে সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে তাতে রয়েছে উনিশ ও বিশ শতকের বারো জন বরেণ্য বঙ্গনারীকে নিয়ে আলোচনা।
রাত গড়িয়ে গেল। এ বারের মতো শেষ হল কলকাতা বইমেলা। তখনও মিলনমেলা প্রাঙ্গণে মানুষের ঢল। ভাবখানা যেন, বাড়ি ফিরতে পারি, কিন্তু কেন ফিরব ?
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।