কানহাইয়া কুমারের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগকে কেন্দ্র করে উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে একটা ছোট্ট খবর হয়তো অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে। খবরটি হল, নির্বাচনে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে চেয়ে সংসদে পেশ করা একটি বেসরকারি বিল প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। অনেকেই বলবেন, বিল তো প্রত্যাহার হয়ে গিয়েছে, তা হলে এ নিয়ে আর আলোচনার কী আছে ? কিন্তু প্রশ্ন হল, দেশের কোনও কোনও প্রান্তে গত কয়েক বছর ধরে ভোটদান বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা হচ্ছে। ভোট দেওয়া কি আদৌ আইন করে বাধ্যতামূলক করা যায় ? এটা কি ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী নয় ?
বাধ্যতামূলক ভোটদান সংক্রান্ত বিলটি লোকসভায় পেশ করেন বিহারের মহারাজগঞ্জ থেকে নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ জনার্দন সিং সিগরিওয়াল। সিগরিওয়াল পুরনো জনপ্রতিনিধি। এর আগে বিহার বিধানসভায় চার বার নির্বাচিত হন। বিলটি পেশ করে তিনি বলেন, ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করা সত্ত্বেও ৩৪ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দেননি। যাঁরা ভোট দেবেন না তাঁদের শাস্তি দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন সিগরিওয়াল। তাঁর বিলে প্রস্তাব ছিল, যিনি ভোট দেবেন না তাঁর ৫০০ টাকা জরিমানা হতে পারে অথবা দু’ দিনের কারাদণ্ড অথবা তাঁর রেশন কার্ড বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে অথবা কোনও নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার তিনি হারাতে পারেন অথবা সরকারি মালিকানাধাধীন সংস্থার বাড়ি বা জমি পাওয়ার ব্যাপারে তিনি অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন, ঋণ বা কোনও কল্যাণমূলক প্রকল্পের সুবিধা থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা যেতে পারে। আর তিনি যদি সরকারি কর্মচারী হন, তা হলে তাঁর ১০ দিনের বেতন বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে অথবা চাকরি ক্ষেত্রে তাঁর পদোন্নতি দু’ বছর পিছিয়ে যেতে পারে।
আমাদের দেশে ভোটদান বাধ্যতামূলক করার প্রচেষ্টা আগেও হয়েছে। এর আগে নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় গুজরাতে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা হয়েছে। গুজরাত বিধানসভায় ‘গুজরাত লোকাল অথরিটিজ ল’জ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০০৯’ পাস হয়। কিন্তু তদানীন্তন রাজ্যপাল কমলা বেনিওয়াল বিলে সম্মতি না দিয়ে ফেরত পাঠান। শুধু তা-ই নয়, কেন এই বিলে সম্মতি দেওয়া যায় না সে সম্পর্কে তিনি জানান, “ভোটারকে ভোট দিতে বাধ্য করা ব্যক্তিস্বাধীনতা নীতির পরিপন্থী”। বিলে কোনও পরিবর্তন না করে যখন গুজরাত বিধানসভা বিলটি ফের রাজ্যপালের সম্মতির জন্য পাঠায়, বেনিওয়াল বিলটি ঝুলিয়ে রাখেন। শেষে রাজ্যপাল পরিবর্তন হয়। ও পি কোহলি রাজ্যপাল হয়ে এসে বিলে সম্মতি দেন। গত বছরের শেষের দিকে গুজরাতে স্থানীয় স্বশাসিত সংস্থাগুলির ভোটের কথা মাথায় রেখে রাজ্য সরকার বাধ্যতামূলক ভোটদান সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করেন। তাতে বলা হয়, যে ভোটার ভোট দেবেন না তাঁকে ১০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে। এর বিরুদ্ধে আইনজীবী কে আর কোষ্ঠী মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে গুজরাত হাইকোর্ট বলে, ভোট দেওয়ার অধিকারের মধ্যেই ভোট না-দেওয়ার অধিকার নিহিত আছে। হাইকোর্ট বিলটি স্থগিত করে দেয়।
মজার কথা হল, শুধু বিজেপি-শাসিত গুজরাতই নয়, কংগ্রেস-শাসিত কর্ণাটকও স্থানীয় স্বশাসিত সংস্থাগুলির নির্বাচনে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ব্যাপারে গুজরাতের আদলেই গত এপ্রিলে কর্ণাটক বিধানসভায় কর্ণাটক পঞ্চায়েত রাজ (সংশোধনী) বিল ২০১৫ পেশ করা হয়। বিধানসভায় সেটি পাস হওয়ার পর রাজ্যপাল তাতে সম্মতি দেন। তবে ভোট না দেওয়ার জন্য কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা নেই এই বিলে।
সিগরিওয়ালের বেসরকারি বিলটি নিয়ে যখন সংসদে আলোচনা হয় তখনও বিভিন্ন দলের কিছু সাংসদ বিলটি সমর্থন করেন। যেমন, টিআরএস-এর কে কবিতা, এনএলডি-র দুষ্যন্ত চৌটালা প্রমুখ।
এ ধরনের আইনের সমর্থক যাঁরা, তাঁদের বক্তব্য অনেক জায়গায় দলিত শ্রেণির মানুষদের ভোট দিতে দেওয়া হয় না। ভোটদান বাধ্যতামূলক করা হলে এই প্রবণতা বন্ধ করা যাবে। এ ছাড়া, মাওবাদী ও বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলিকে সরকার জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে পারবে। এরা ভোট বয়কটের ডাক দেয়। ভোটদান বাধ্যতামূলক হলে তারাও সরকারের অংশ হতে পারবে এবং সরকার চালানোর ক্ষেত্রে তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
অস্ট্রেলিয়া, পেরু, ব্রাজিল, বেলজিয়াম সহ ২৯টি দেশে ভোটদান বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা হয়েছে। কিছু দেশে আইনের বইতেই এটি সীমাবদ্ধ রয়েছে। তারা জোর করে এটি রূপায়ণ করার চেষ্টা করে না। অস্ট্রেলিয়া আর বেলজিয়ামে যেমন ভোট না দিলে শাস্তির ব্যবস্থা আছে, তেমনই পেরু বা ব্রাজিলে ভোট দিলে রাষ্ট্রপ্রদত্ত সুযোগসুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তার টোপ দেওয়া হয়।
এ ধরনের আইনের যাঁরা বিরোধী তাঁরা মনে করেন, এতে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে। এটা গণতান্ত্রিক আদর্শের বিরোধী। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে মনে করেন, নির্বাচনের অর্থ হল ভোটারের পছন্দ-অপছন্দ জানা। একজন প্রার্থী সম্পর্কে যেমন ভোটারের পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে, তেমনই ভোট দেওয়া বা না-দেওয়াও ভোটারের পছন্দ-অপছন্দের এক্তিয়ারে পড়ে। তা ছাড়া একজন ভোটারকে ভোটের লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করার মধ্যে একটা অনুদার নীতির গন্ধ পাওয়া যায়। বাধ্যবাধকতাকে ঘৃণা করার মধ্যেই উদারনীতির শিকড় প্রোথিত। কারণ উদারনীতি ব্যক্তিবিশেষকে, তাঁর বিবেক, তাঁর যুক্তিকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। আর কোনও কিছু নিয়ে জোর করলে উদারনীতির মূলেই আঘাত করা হয়।
তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় স্পষ্ট বলেছেন, “এই বিল গণতন্ত্রের মূল ধ্যানধারণার পরিপন্থী। ভোটদান জনগণকে প্রদত্ত একটা অধিকার। এখন সেই অধিকার মানুষ প্রয়োগ করবে কিনা সেটা তাঁর ব্যাপার। সংবিধানের ১৯ (১) অনুচ্ছেদই তো সাধারণ মানুষকে ভাব প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। যদি কেউ বলেন, ‘আমি ভোট দিতে যাচ্ছি না, কারণ আমি এই ব্যবস্থায় বিশ্বাস করি না’ তা হলে তাঁর সেই ভাব প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না”।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।
Visitor Rating: 1 Stars