পাপিয়া মিত্র
ঋতু পরিবর্তনের আনন্দ-বেদনা উপলব্ধি করতে পারে না ওরা। খিদের অনুভূতিটুকু ঠিকঠাক বোঝাতে পারে না ওরা। নিজের ইচ্ছার কথা জানাতে পারে না ওরা। ওদের কখন ঘুম পায়, কখন গান গাইতে হবে, কখন আঁকতে হবে তা জানে না। তাই ওরা বড় নির্ভরশীল। আর এই সমাজসেবার কাজে সেই নির্ভরশীলতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ‘ডিভাইন স্মাইল’।
এই সংস্থার সহযোগিতায় ওরা পরকে আপন নেওয়ার সহজাত ক্ষমতাটুকু অর্জন করে নিতে পেরেছে। ওরা গান গাইছে, হাতের কাজ করছে, নাচে, আধো আধো ছড়ায় ভরিয়ে তুলেছে ঘর। হেরে যাওয়ার কথাটা ওই মানসিক প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের অভিধানে নেই। ছাত্র-ছাত্রী কথাটা লিখলাম একটাই কারণে –- ওরা প্রত্যেকে ‘ডিভাইন স্মাইল’-এ চার ঘণ্টা করে ক্লাস করে।
এই সংস্থার কর্ণধার মায়া বিশ্বাস। হঠাৎ করে তিনি এই মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে মেতে উঠলেন কেন ? আসলে এই পাঠ নিজেরই জীবন থেকে নেওয়া, নিজেরই সংগ্রাম মধ্য থেকে নেওয়া। তিন সন্তানের ছোট দুই পুত্র জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। কিন্তু সংসার থেকে দূরে সরে থাকার কথা চিন্তা করেননি মায়াদি। ১৯৮৭-তে গড়ে তুললেন মানসিক প্রতিবন্ধী শিক্ষাদান কেন্দ্র। ধীরে ধীরে খবর ছড়িয়ে পড়ল। এত দিন যে সব সন্তান সংসারের বোঝা হয়েছিল, অভিভাবকেরা যাদের নিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরাই এগিয়ে এলেন মায়াদির পাশে। চড়াই-উতরাই পার হয়ে এগিয়ে চলার পথ একটু প্রশস্ত হলেই বাধা এসে দাঁড়ায়। কিন্তু হেরে যাওয়ার মানুষ তিনি নন। অবশেষে ১৯৯৫-তে নিজের বাড়ির মেজেনাইন ফ্লোরে শুরু করলেন মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নানা গঠনমূলক কর্মসূচি। নানা বয়সের মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানদের হাত ধরে যোগ দিলেন অভিভাবকেরাও। তারাই ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে, বেরিয়ে এসেছে অন্ধকার থেকে। প্রতি বছর সরস্বতী পুজো, প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবস, নববর্ষ, রবীন্দ্র-নেতাজি-স্বামীজি জয়ন্তীর দিন নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে প্রতিভার সাক্ষর রেখে চলেছে।
শেষ পর্যন্ত অদম্য মনোবল ও অফুরান প্রাণশক্তি নিয়ে এগিয়ে চলা বড়িশা সখেরবাজারের মায়া বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয় হয় ‘ রিহ্যাবিলেটেশন সেন্টার ফর চিলড্রেন’-এর সক্রিয় কর্মী সমাজসেবিকা মিস যেন ওয়েভ-এর সঙ্গে। এগিয়ে আসে আরও নানা সংস্থা। জড়বুদ্ধিসম্পন্ন শিশুদের সুস্থ ভাবে গড়ে তোলার জন্য মায়াদেবী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথাগত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নিজের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান নিয়ে হাতেকলমে শিখিয়েছেন অন্য শিক্ষিকাদের। মায়াদেবী জানালেন, বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২২। চল্লিশ বছর বয়স, এমন শিক্ষার্থীও আছেন এখানে। কিন্তু বাধ সাধছে অর্থ। এগিয়ে চলার পথে এটা একটা বড় অন্তরায়। কিছু শুভানুধ্যায়ী ও সংগঠন আর্থিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এলেও, প্রয়োজনের তুলনায় তা বড়ই কম।
বিভিন্ন জায়গা থেকে উৎখাত হয়ে আসা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের জন্য একটি হোম গড়ার স্বপ্নও দেখেছিলেন মায়াদেবী। কিন্তু সেখানেও অর্থই অন্তরায় হয়ে ওঠে। তাই অনন্যোপায় হয়ে নিজের ফ্ল্যাটেই কাজ শুরু করেন মায়াদেবী। সেখানেই আয়োজিত হয় নানা উৎসব-অনুষ্ঠান, চলে পড়াশোনা-নাচগান, সেলাই-কাটিং-আঁকার প্রশিক্ষণ।

সংস্কারভারতীর বেহালা শাখা এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গত ২৬ জানুয়ারি জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষগুলোর হাতে তুলে দেয় নানা খাদ্যসামগ্রী। শিক্ষার্থীরা নাচে, গানে অনুষ্ঠানটিকে মনোরম করে তোলে। ৩১ জানুয়ারি ‘ডিভাইন স্মাইল’ ওদের জন্য ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল ওই এলাকায়। বিভিন্ন সংস্থার প্রায় ৬০ জন প্রতিযোগী তাতে যোগ দিয়েছিলেন। যে সব সংস্থা ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয় তারা হল, নির্মল নিকেতন, সাউথ ক্যালকাটা আনন্দ নিকেতন হোম, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব মাদার অ্যান্ড চাইল্ড ওয়েলফেয়ার, জয়শ্রী পার্ক উদ্ভাস স্প্যাসটিক ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, বেহালা নবপ্রয়াস, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সেরিব্রাল পালসি, বেহালা বিকাশন, ভয়েস অব ওয়ার্ল্ড আর ডিভাইন স্মাইল। সকল প্রতিযোগীকে পুরস্কৃত করেন মায়াদেবী। কারণ, এটা প্রতিযোগিতা হলেও সকল প্রতিযোগীই যেন পুরস্কার নিয়ে বাড়ি যান, এটাই চেয়েছিলেন মায়াদেবী। আসলে তো এর উদ্দেশ্য ছিল, প্রতিযোগিতার মোড়কে জড়বুদ্ধিদের কোনও কাজে উৎসাহদান। সেই কাজে সফল মায়া বিশ্বাস, যিনি মানসিক প্রতিবন্ধীদের মুখে স্বর্গীয় হাসি ফোটাতে চান।
ছবিঃ লেখিকা
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।