খবর অনলাইন ডেস্ক: কথা হচ্ছিল সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। উনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রথম শ্রেণির এক বাংলা দৈনিকের সাংবাদিক ছিলেন। মূল মাসমাইনে ছিল ১৫ হাজার টাকার অনেক বেশি। ২৯ ফেব্রুয়ারি পেশ করা বাজেটের খবরে তাঁর মুখে যেন একটা স্বস্তির চিহ্ন।
‘কী ব্যাপার ?’ – জানতে চাইতেই বলে ফেললেন, “খুব জোর বেঁচে গেছি। বয়সটা যদি কয়েক বছর কম হত অর্থাৎ রিটায়ারমেন্ট যদি কয়েক বছর পরে হত, তা হলেই চিত্তির। হাতে তো পিএফের টাকা কী পেতাম কে জানে ? আমাদের তো আবার পেনশনের নামে যা পাওয়া যায় তা মুখে বলা যায় না।”
সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক মহোদয় হয়তো স্বস্তি পেয়েছেন, কিন্তু পিএফের টাকায় করের প্রস্তাবে যারপরনাই ক্ষুব্ধ চাকরিজীবী মহল। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্ম। যাঁরা অবসরের দোরগোড়ায় তাঁরা হয়তো ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, যতটা হবেন কমবয়সি চাকুরেরা। পিএফে করের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বলা হচ্ছে, এই প্রস্তাব মধ্যবিত্তের উপর বড় ধরনের কোপ। এর প্রতিবাদে আগামী ১০ মার্চ সারা দেশে ধর্মঘট ডাকার পরিকল্পনা করছে ১১টি কর্মী সংগঠন।
চাকরিজীবীদের প্রশ্ন, এই কর প্রস্তাবের ফলে ইপিএফে কি ‘ডাবল ট্যাক্সেশন’ হয়ে যাচ্ছে না ? কারণ এখন আয়কর আইনের ৮০সি ধারা অনুযায়ী, ইপিএফ, জীবনবিমা ও পিপিএফ সব মিলিয়ে দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়ে ছাড় মেলে। ফলে কেউ যদি জীবনবিমা আর পিপিএফেই দেড় লক্ষ টাকা জমিয়ে ফেলেন, তা হলে ইপিএফে আর কার্যত কর ছাড় মেলে না। এ বার অবসরের সময় আবার সেই ইপিএফের টাকায় কর বসানো হচ্ছে।
কর প্রস্তাবে কী আছে ? একটু ভালো করে বোঝা যাক।
ওই প্রস্তাবে বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার কর্মচারীদের এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড (ইপিএফ)-কে করের আওতায় আনার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই প্রস্তাব কার্যকর হওয়ার কথা আগামী আর্থিক বছরের ১ এপ্রিল থেকে।
ধরা যাক, আপনার অবসরের সময় পিএফে সঞ্চিত টাকার পরিমাণ ১৫ লক্ষ। এর মধ্যে ৫ লক্ষ টাকা জমেছে ২০১৬-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত। বাকিটা জমেছে ২০১৬-এর ১ এপ্রিল থেকে অবসর পর্যন্ত।
প্রথম ধাপের ৫ লক্ষ টাকা করমুক্তই থাকছে।
পরের ধাপে জমানো ১০ লক্ষ টাকার ৪০ শতাংশ বা ৪ লক্ষ টাকা তুলতে গেলে কোনও কর দিতে হবে না।
বাকি ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ লক্ষ টাকা তুলতে গেলে কর দিতে হবে। কারণ তাকে আয় হিসাবে দেখানো হবে। তবে ওই ৬ লক্ষ টাকায় পেনশন প্রকল্প বা বা অ্যানুইটি কিনলে করে রেহাই মিলবে।
আবার কর্মচারীর পিএফে নিয়োগকর্তার ‘কন্ট্রিবিউশন’ যদি বছরে দেড় লক্ষ টাকার বেশি হয়, তা হলে তা কর্মচারীর করযোগ্য আয় হিসাবে ধরা হবে।
মাসিক মূল বেতন ১৫ হাজার টাকা বা তার কম হলে পিএফ পুরোপুরি করমুক্ত।
করপ্রস্তাবের সমর্থনে কেন্দ্রের যুক্তি –
(১) পিএফের পুরোটার ওপর তো কর বসছে না, ৬০ শতাংশের ওপর বসছে।
(২) এই কর দিতে হবে মূলত বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত অপেক্ষাকৃত বেশি রোজগেরেদের। কারণ, ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল বেতনের কর্মীদের কর গুনতে হবে না।
(৩) সরকারি হিসেব অনুযায়ী ইপিএফে টাকা রাখা ৩ কোটি ৭০ লক্ষ জনের মধ্যে ৩ কোটিরই মূল বেতন মাসে ১৫ হাজারের কম। সুতরাং এই করের আওতায় আসছেন মাত্র ৭০ লক্ষ মানুষ।
(৪) ব্যাঙ্ক, ডাকঘরের আমানতে সুদে কর গুনতে হয়, তা হলে ইপিএফ বাদ যাবে কেন ?
(৫) পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ডে (পিপিএফ) কর বসছে না। বদল হচ্ছে না সরকারি কর্মীদের পিএফেও।
সরকারের আরও যুক্তি, অবসরের পরে বেসরকারি সংগঠনের কর্মীরা যাতে পেনশন প্রকল্পগুলির দিকে ঝোঁকেন, তার জন্যই সংস্কারের এই পদক্ষেপ। কিন্তু শাসক দলের শ্রমিক সংগঠন বিএমএস-সহ সব শ্রমিক সংগঠন মনে করিয়ে দিয়েছে, যে কোনও ধরনের প্রকল্প থেকে পাওয়া পেনশনও করযোগ্য। আসলে জাতীয় পেনশন প্রকল্প (এনপিএস) থেকে টাকা তোলার সময় কর দিতে হয়। কিন্তু ইপিএফে কর দিতে হয় না বলে এনপিএস-এ সাড়া মেলে না। চাকরিজীবীদের পেনশন প্রকল্পের দিকে টানতেই কেন্দ্রের এই প্রস্তাব।
তবে চার দিক থেকে চাপের মুখে পড়ে কেন্দ্র হয়তো কিছুটা পিছিয়ে আসবে। অন্তত ইঙ্গিত সে রকমই। শেষ পর্যন্ত হয়তো মোট তহবিলের ৬০ শতাংশের ওপর নয়, শুধু সুদের ওপর কর বসতে পারে।
বহু অর্থনীতিবিদ নাকি মনে করেন, পিএফে সুদ আর্থিক সংস্কারের দিকে একটা বড় পদক্ষেপ। কিন্তু আর্থিক সংস্কারের নাম শুনলেই মধ্যবিত্ত মানুষজন ভীত হয়ে ওঠেন। তাঁদের প্রশ্ন, বার বার তাঁদের পকেট কেটেই কেন আর্থিক সংস্কারের দিকে এগোতে হয় ?
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।
Visitor Rating: 1 Stars