‘দেশদ্রোহিতা’র জল অনেক দূর গড়াল। কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্যের পর এখন এই অভিযোগের দায়ে অভিযুক্ত রাহুল গান্ধী, সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজা এবং অরবিন্দ কেজরিওয়াল সহ বিরোধীপক্ষের সাত নেতা। কানহাইয়া কুমারের গ্রেফতারির জেরে দেশ জুড়ে যে উত্তপ্ত রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত শাসক-বিরোধী দ্বৈরথে দাঁড়িয়ে গেল।
বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের এক ভূমিহার পরিবারের সন্তান কানহাইয়া কুমার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের পদক্ষেপে সংবাদের শিরোনামে উঠে আসেন। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) ছাত্র সংসদের সভাপতি এআইএসএফ নেতা কানহাইয়া ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র অভিযোগে গ্রেফতার হন। কানহাইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, জেএনইউ ক্যাম্পাসে আয়োজিত এক সভায় তিনি ‘দেশবিরোধী’ ও ‘আজাদি’র পক্ষে স্লোগান দিয়েছিলেন। সেই সভায় পাকিস্তানের পক্ষেও স্লোগান ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢোকে, কানহাইয়াকে গ্রেফতার করে। পুলিশের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। এই হামলায় বহিরাগতরাও হাত মিলিয়েছিল বলে অভিযোগ। কানহাইয়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, আজাদির পক্ষে স্লোগান দিচ্ছিলেন বলে ভিডিও প্রচার করা হয়। অনেকেই বলেছেন, এই ভিডিও জাল। অন্য দিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের হাতে আসা একাধিক ভিডিও-য় দেখা গিয়েছে, সে দিন কানহাইয়া দারিদ্র, অনাহার, জাতপাত, আরএসএস-এর মনুবাদী নীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে আজাদির স্লোগান দিয়েছিলেন। এমনকী কানহাইয়া সে দিন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে তোলা স্লোগানের কড়া নিন্দাও করেছিলেন। ভিডিওগুলি জাল কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হবে এবং প্রয়োজনে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নিউজ ব্রডকাস্টিং অথরিটি অব ইন্ডিয়ার প্রধান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে টি রবীন্দ্রন।
ইতিমধ্যে জেএনইউ-এর ঘটনার সঙ্গে লস্কর জঙ্গি হাফিজ সইদের যোগ আছে বলে সরকারের বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়ে দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। হাফিজ সইদের নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্টের ভিত্তিতে রাজনাথ ওই মন্তব্য করেন। দিল্লি পুলিশ জানায়, পরে ওই টুইটার অ্যাকাউন্টটি ডিলিট করে দেওয়া হয়। একটি সংবাদ চ্যানেলে প্রচারিত ভিডিও-র ভিত্তিতে দিল্লি পুলিশ ১১ ফেব্রুয়ারি যে এফআইআর নথিভুক্ত করে, তাতে কোথাও কানহাইয়ার নাম নেই। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে জমা দেওয়া এক স্ট্যাটাস রিপোর্টে দিল্লি পুলিশ অভিযোগ করে, জেএনইউ-এর যে সমাবেশে রাষ্ট্রদ্রোহী স্লোগান দেওয়া হয়েছিল, তাতে ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস ফ্রন্ট, এআইএসএফ (কানহাইয়া যার সদস্য), এসএফআই এবং অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মীরাও ছিল।
পাটিয়ালা হাউজ কোর্টে কানহাইয়াকে হাজির করার দিন পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়। মারধর করা হয় কানহাইয়া, সাংবাদিক এবং জেএনইউ-এর শিক্ষক, ছাত্রদের। এই ঘটনায় বেশ কয়েক জন আইনজীবী ও জনপ্রতিনিধিও জড়িত ছিলেন। পরেও এই মারধরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। গোটা ঘটনায় অভিযুক্ত দিল্লি পুলিশও। দিল্লির পুলিশ কমিশনার বি এস বাস্সি আদালত চত্বরে কানহাইয়াকে মারধরের ঘটনা অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু কানহাইয়ার মেডিক্যাল রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন আছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও জানিয়েছে, আদালত চত্বরে পুলিশের সামনেই কানহাইয়ার ওপর হামলা হয়েছে।
কানহাইয়া এখন জেলে। তাঁর জামিন চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, তাঁকে দিল্লি হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করতে হবে। সেই নির্দেশ মেনে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্ট ও পাটিয়ালা হাউজ কোর্ট একই চত্বরে। তাই সুপ্রিম কোর্ট কানহাইয়া-সহ সকলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য দিল্লি পুলিশ ও কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমারের কাছ থেকে আশ্বাসও আদায় করেছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। আগামী কাল ১ মার্চ কানহাইয়া কুমারের জামিনের মামলা দিল্লি হাইকোর্টে উঠবে। জেলে রয়েছেন অন্য দুই অভিযুক্ত উমর খালিদ এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্য, যাঁরা দিল্লি হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
এই সুযোগে বিজেপি ও আরএসএস-এর বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে পড়ে বেশির ভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল। পক্ষে-বিপক্ষে পথে নামেন দেশের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ। দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে জেএনইউ-এর ঘটনার আঁচ পড়ে। বাদ যায়নি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও। যাদবপুর নিয়ে উপাচার্য সুরঞ্জন দাশের কাছে রিপোর্ট চান আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। উপাচার্য তাঁর রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছেন রাজ্যপালের কাছে। বিদেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়েও জেএনইউ-এর ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বলতে ঠিক কী বোঝায় সেই নিয়েও বিশেষজ্ঞ মহলে শুরু হয়ে যায় তর্ক-বিতর্ক।
সব মিলিয়ে কানহাইয়ার গ্রেফতারি নিয়ে রাজনীতির আসর যখন সরগরম, তখন সাত বিরোধী রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগে এফআইআর এক নতুন মাত্রা যোগ করল। হায়দরাবাদের আইনজীবী জনার্দন গৌড় স্থানীয় মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অভিযোগ করেছেন, দিল্লি পুলিশ কানহাইয়া কুমারের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগ এনেছে, এটা জানা সত্ত্বেও কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী, অজয় মাকেন ও আনন্দ শর্মা, সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই নেতা ডি রাজা, জেডিইউ সাংসদ কে সি ত্যাগী এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁকে সমর্থন করেছেন। সুতরাং তাঁদের এই কাজ দেশদ্রোহের নামান্তর। কানহাইয়া কুমার ও উমর খালিদের পাশাপাশি এঁদের বিরুদ্ধেও ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগে মামলা করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিতে আর্জি জানান গৌড়। আদালতের আদেশের ভিত্তিতেই ওই সাত নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে বলে হায়দরাবাদের সারওরনগর থানার ইনস্পেক্টর জানান।
ঘটনার নিন্দায় নেমে পড়েছে প্রায় সব রাজনৈতিক দল। আগামী কাল সংসদে বাজেট পেশ হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ দিনেও সংসদের অধিবেশন যে ‘দেশদ্রোহিতা’র ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে তা সহজেই বলা যায়।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।
Visitor Rating: 3 Stars