
একটি পরিবার আসলে কী? বায়োলজিক্যাল? নাকি ছোটো ছোটো আনন্দের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পারস্পরিক সম্পর্ক?
আর অপরাধ? অপরাধও শেষ পর্যন্ত একটি দৃষ্টিভঙ্গি। খেতে না পাওয়া মানুষ চুরি করলে সেটা কি অপরাধ হিসেবেই ধরা হবে? কেন? খেতে পাওয়া কি মানুষের প্রাথমিক অধিকার নয়?
কোরে-ইদা হিরোকাজুদেখিয়ে দেন ক্ষুদ্র আনন্দই আসলে সব। আর অপরাধ কে বিচার করছে, সমাজের কোন অবস্থান থেকে বিচার করছে তা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। হ্যাঁ, শপলিফটার্স-এর কথাই বলছি।
টোকিওর বড় বড় অট্টালিকার অদূরে কোনো এক ছোট্ট বস্তিতে বাস করে এক পরিবার। মা, বাবা, ঠাকুমা, কিশোরী কন্যা, এক কিশোর ও প্রবল শীতে কাঁপতে থাকা একাকী এক বাচ্চা মেয়ে যাকে তারা আশ্রয় দিয়েছে; পরিবারের সদস্য এই ক’জন।
এরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তা নিয়ে প্রবল সামাজিক মূল্যবোধের ধার ধারে না কেউ। যদিও কিশোর শোতা মাঝে মাঝেই প্রশ্ন তোলে। কিশোরী আকি একবার প্রশ্ন তোলে ছোট্ট মেয়েটিকে নিজেদের কাছে রেখে দেওয়া কি কিডন্যাপিং নয়? যখন ছোট্ট মেয়েটির হারিয়ে যাওয়া নিয়ে টিভিতে খবর দেখানো হয়। কিন্তু তার প্রশ্ন সত্ত্বেও ছোট্ট মেয়েটির পরিচয় গোপন করতে তার চুল কেটে লুকস বদলে দেওয়া হয়।
বাবা ওসামু, ছেলে শোতাকে নিয়ে বিভিন্ন দোকান থেকে জিনিসপত্র চুরি করে। ছোট্ট মেয়ে জুরিকে তারা শেখায় কীভাবে দোকান থেকে চুরি করতে হয়।কোনো একটা জিনিস চুরির আগে শোতা ও জুরি হাতের পাঁচ আঙুলে সংকেত করে। দেখে মনে হয় এই সংকেত একটা রিচুয়াল যেন। সর্বশক্তিমান হয়ে ক্ষমতাবানদের ভয় দেখানোর রিচুয়াল। দর্শকদের শিউরে দেওয়ার রিচুয়াল।
কিশোরী আকি শহরের সফট পর্ণ পিপ শো-তে কাজ করে পরিবারকে সাহায্য করে। সমুদ্রে ঘুরতে যাওয়ার আগে ছোট্ট জুরির জন্য রীতিমতো ট্রায়াল রুমে ট্রায়াল দিয়ে সমুদ্র স্নানের পোশাক চুরি করে আনে বাড়ির মেয়েরা। সমুদ্রে পিকনিকের জন্য তৈরি হয় খাবার। সমুদ্রে গিয়ে তাদের সে কি উল্লাস!
খাওয়া ও রান্নার দৃশ্যগুলি ঈর্ষনীয়ভাবে ঘনিষ্ঠ। যেন একে অন্যকে ছেড়ে তারা কোথাও যাবে না কখনো। যে কোনো পরিবারে এক বৃদ্ধার ভূমিকা যেমন এই পরিবারের ঠাকুমা তার থেকে বেশি কিছু। নিজের বিছানায় জুরিকে আশ্রয় দেওয়া থেকে (যে এখনো বিছানা ভেজায়), কিশোরী আকিকে দেখেই তার সব অনুভূতি বুঝে নেওয়া, পরিবারের সবার সবদিক খেয়াল রাখা ঠাকুমা যেন এক ক্ল্যাসিক দৃষ্টান্ত।
আহ! সেই দৃশ্যটা, যখন ছোট্ট জুরিকে শীতের কবল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে জড়িয়ে উত্তাপ দেওয়া হচ্ছে। মানুষ মানুষকে জড়ালে শুধু তাপমাত্রাই কি বাড়ে? মনের কোনেও কি শোনা যায় না কুলুকুলু ধ্বনি?
এই শত জল ঝরনার ধ্বনি আপনাকে প্লাবিত করবে। শেষমেশ যখন জানা যাবে আসলে এই পরিবারটি বায়োলজিক্যাল নয়। এক জায়গায় জড়ো হওয়া কিছু মানুষ যারা পরস্পরকে জড়িয়ে বাঁচতে চায়ছে। ঠাকুমার পেনশনের টাকা কোথা থেকে আসছে, আকিই বা কে, মানবয়ু ও বাবা ওসামুর আসল সম্পর্কই বা কি, তাতে কিছুই যায় আসে না। তাই পুলিশের চক্করে না পড়া পর্যন্ত দর্শক বুঝতেই পারে না এই পরিবারের সদস্যদের আসল সম্পর্ক।
জাপানি ক্ল্যাসিক পরিচালকদের ছোঁয়া গল্প বলার ধরনে। আর এক ‘দ্য লোয়ার ডেফথ’। তবে আধুনিক বিশ্বের।
অসম্ভব মন খারাপ করা লাইটিং কাহিনিকে যথাযথ সঙ্গত দেয়।
মিচাল আভিয়াদ দেখে নিয়েছেন কত ধানে কত চাল। ষাটোর্ধ মিচাল তাই বিবাহিত কর্মরত মেয়েদের সংকট বোঝেন হাড়ে হাড়ে। একজন মেয়ে পরিচালকের সুক্ষ অনুভূতিগুলো পাওয়া যায় ওয়ার্কিং ওম্যান সিনেমায়।
ফিল্মের প্রথমেই অরনা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে হাঁটছে। ক্যামেরা তাকে প্রোফাইলে ধরে অনুসরণ করছে। তার অবয়বে লেগে থাকে চাকরি পাওয়ার আনন্দ। কিন্তু তখনো সে জানে না কী মূল্য তাকে দিতে হবে। কিভাবে ফিকে হয়ে যাবে সম্পর্কগুলি। কিভাবে সে হারাবে তার ন্যায্য পাওনা। তাই ফিল্মের শেষে যখন সে আর একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে হাঁটে তাতে শুরুর গতি থাকলেও পাল্টে যায় তার বডি ল্যাংগোয়েজ।
#মিটু জমানায় দাঁড়িয়ে এই ফিল্ম অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়। আর অবশ্যই ধোঁয়াটেও থেকে যায় কিছু কিছু অনুভূতি।
অরনার স্বামী যখন জানতে চায় অরনার বস যখন তার স্তন স্পর্শ করেছিল ও লেপ্টে ধরেছিল দেয়ালের সঙ্গে তার আগে অরনা কি কিছুই বুঝতে পারেনি? যদি বুঝতেই পেরেছিল তো প্যারিস গিয়ে এই কাণ্ড ঘটানোর দরকারটা কি ছিল? আর কেনই বা সে বসকে বাধা দেয়নি।
তিন সন্তানের জননী অরনার কাছে সবকিছুর উত্তর নেই বা সে কিভাবে দিনের পর দিন বসের ব্যবহার উপেক্ষা করে মন দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছে তা ব্যাখ্যা করার এনার্জিও সে পায় না। কৈফিয়ত চাওয়াও তো এক ধরনের অসম্মান। দিলেই বা বুঝবে কে?
অরনা থেকে যাবে একাকী, নিঃসঙ্গ।
আবার খুঁজতে বেরোবে কাজ। যে পরিবার থেকে তার অসম্মানই প্রাপ্য তাদের মঙ্গলার্থেই তাকে কাজ করে যেতে হবে। সন্তান অসুস্থ হলে দায়িত্ব নিতে হবে তাকেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পুরুষ অভিভাবকহীন মহিলারা ঘর থেকে বেরোয় চাকরির সন্ধানে। লাখে লাখে পঙ্গু বা মৃত বা নিরুদ্দেশ সৈনিকদের পরিবারের মহিলারা সংসার বাঁচাতে কাজ করতে থাকে। পরিবারের সমান্তরালে কাজের জায়গায় মেয়েদের ওপর নানারকম নির্যাতনের সেই শুরু। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
এই ফিল্ম উসকে দেয় ‘মহানগর’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘আ ব্রিফ ভ্যাকেশন’-এর স্মৃতি।
নুরি বিলগে জেলা ওরফে নুরি বিলজ সেলান অমোঘ কিছু বিষয় নিয়ে দীর্ঘ ও প্রাসঙ্গিক কিছু সংলাপ পরম্পরা দর্শকদের উপহার দিয়েছেন দ্য ওয়াইল্ড পিয়ার ট্রি ফিল্মে। পাশাপাশি পোয়েটিক সিনেমাটোগ্রাফি যথার্থ সঙ্গত করেছে।
সিনান নামের তরুণ স্নাতক স্তরের পড়া শেষ করে গ্রামে ফিরে আসে। তার স্বপ্ন লেখক হওয়ার। কিন্তু তাকে একের পর এক বিরূপ অবস্থার ভেতর দিয়ে এগোতে হয়। কেউ তার বই প্রকাশ করতে সহায়তা করে না। বিখ্যাত লেখক তার পাণ্ডুলিপি পড়ে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছুক নয়। তাতে তাঁর নিজের লেখার ক্ষতি হয়।
বড় লেখক হওয়ার পিছনের গল্পটার কিছু আভাস দেন বিখ্যাত লেখক। খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ের প্রবল ব্যাথাও যে মেনে নিতে হবে! সিনানের প্রশ্নে ও সান্নিধ্যে তিনি বিরক্ত বোধ করেন এবং তা লুকানোরও চেষ্টা করেন না।
সিনান তার বাবার মতোই বেকার, গুরুত্বহীন হয়ে যেতে থাকে।
যদিও তার কাছে উড়ে আসে প্রেম, উড়ন্ত ম্যাপেল পাতার সঙ্গী হয়ে।যেন শীতে পাতা ঝরিয়ে বর্ণহীন প্রকৃতির মতো তার বর্ণহীনতার প্রস্তুতি চলে।
নিজেই বই প্রকাশ করলেও কেউ পড়ে না তা, কোথাও বিক্রি হয় না। কেবল ছিন্ন এক কাগজে তার বইয়ের আলোচনা খুঁজে পায় সে যা তার বাবা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। কেউ না পড়লেও বাবা তার বই পড়েছে, একেকটি পাতা একাধিক বার। তাতেই সে খুশি।
বাবা এমন একজন মানুষ যে টাকা রোজগার করে না কিন্তু জুয়া খেলে। অথচ লোকে বলে সে একসময় দারুণ কর্মঠ ও উদ্যমী ছিল। সমাজ বা পরিবারে জায়গা হয় না তার। নিজের স্বপ্নের ভেড়া আর কৃষি কাজের বাসনা নিয়ে সে নিজের আস্তানা গড়ে নেয়।
ব্যর্থ সিনান বাবার আস্তানায় আশ্রয় নেয়। তার বইগুলো ভিজে পচে নষ্ট হতে থাকে। মন দিয়ে কুয়ো খুঁড়তে থাকে সে, যে কুয়োয় এখনো জল ওঠেনি। আর জল না উঠলে কৃষিকাজ করা সম্ভব হবে না বাবার জমিতে।
একদিন জল উঠবে। গভীর বিশ্বাস।