
ফের একজন মেয়ে পরিচালকের প্রথম ফিল্ম দর্শকদের একেবারে সিনেমা হলের আসনের সঙ্গে লেপ্টে রাখলো।
আদিনা পিনটিলিয়ে সারা ফিল্ম জুড়েখুঁজে বেড়ালেন মানুষের সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠতার স্বরূপ। তা কখনো স্পর্শ, কখনো যৌনতা।
টাচ মি নট ফিল্মে পরিচালক আদিনা কাহিনিচিত্র ও তথ্যচিত্রের মিশেল পদ্ধতি ব্যবহার করেন।শুরুতেই এক নগ্ন পুরুষের শরীর খুব ক্লোজ শটে পা থেকে গলা পর্যন্ত অনুসরণ করে ক্যামেরা। তারপরই দেখা যায় ক্যামেরা মাউন্ট করছে দুজন পুরুষ চিত্রগ্রাহক ও তার সহকারি। লেন্স ফিট করা হয়। লেন্স গার্ড লাগানো হয়। লেন্সের সামনে লাগানো হয় বিশেষ রকম একটা চৌকো কাচ যেটা লেন্সের জন্য ফিল্টার আর যে ইন্টারভিউ দিচ্ছে তার জন্য একটা মনিটর। যেখানে সে সরাসরি পরিচালককে দেখতে পাচ্ছে। লুক ঠিক রাখতে পরিচালককে লেন্সের পাশে মুখ রেখে প্রশ্ন করতে হচ্ছে না।
পরিচালক ঘনিষ্ঠতা বিষয়ে নানারকম মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে থাকেন। আদিনা নিজেই পরিচালকের ভূমিকায় সাক্ষাৎকার পরিচালনা করেন। ক্যামেরার সামনে থাকে লওরা, পঞ্চাশের এক ইংরেজ মহিলা, যে নানারকম মানুষের সঙ্গে কথা বলে চলে ঘনিষ্ঠতা বিষয়ে।
পরিচালক সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারা ভেঙে দিতে চান।
ক্রিস্টিয়ান শিরদাঁড়ার বিশেষ সমস্যায় প্রায় পঙ্গু। হুইল চেয়ারে ঘুরতে হয় তাকে। হাত ও পা ব্যবহার করতে পারে না। দাঁতগুলো উঁচু হয়ে থাকে। ঠোঁটের পাশ দিয়ে কষ গড়ায়। কিন্তু তার যৌনাঙ্গ সক্রিয়। নিজের সৌন্দর্য বিষয়ে সে ব্যাখ্যা দেয় একটা অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে, যার অবস্থান সাধারণ সৌন্দর্য বোধের বাইরে।
লওরা একেক জনকে তার ঘরে নিয়ে আসে। ক্যামেরা রেকর্ড করে চলে। কাউকে লওরা স্পর্শ করতে পারে না। এক পুরুষ বেশ্যা নগ্ন স্নান করে, হস্তমৈথুন করে। লওরা বসে বসে দেখে।
হানার শরীর পুরুষ। কিন্তু মন তার নারী। সে অত্যন্ত বিদগ্ধ ভঙ্গিতে শরীর, স্পর্শ, মিউজিক নিয়ে নানান কথা বলে লওরার সঙ্গে। শরীরের নানান অংশ তার কাছে আলাদা আলাদা ব্যক্তির মতো। যেমন সে তার দুই স্তনের দুটি নাম দেয়। সে নগ্ন হয়। দুই স্তনের সঙ্গে রয়েছে তার পুরুষাঙ্গ। সে লওরাকে বলে, এটিই তার জীবনের সত্য।
টমাস শেখায় এক ধরনের যোগ। স্পর্শ বিষয়ক এক যোগ ব্যায়াম ক্লাসে সে একটা সেশনের পর স্পর্শীত ও স্পর্শকারীর অনুভূতি জানতে চায়। লওরার কাছে একাকী এসে সে লওরাকে আন্দোলিত করতে চায় স্পর্শ দিয়ে, বুকে আঘাত করে। লওরার গভীর অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসে প্রবল আপত্তি ও ক্ষোভ। টমাস অ্যাপ্রিসিয়েট করে এই রাগ।
বিডিএসএম, সমকাম, সেক্স ক্লাব, স্বামী স্ত্রী, বাবা-মেয়ে সম্পর্ক সব আছে এই ফিল্মে। একটা জটিল বিষয় খুঁড়ে দেখতে চেয়েছেন পরিচালক।
কাহিনির চলমানতা মাঝে মাঝেই ভেঙে দেন পরিচালক। নন লিনিয়ার পদ্ধতিতে গল্প বলেন। কাহিনি চলতে চলতে মাঝখানে এসে পড়ে ক্যামেরা, লাইট, শুটিং ইউনিট। কখনো পরিচালক ও লওরা নিজেদের ভূমিকা বদল করে।
ক্রিস্টিয়ান ঘনিষ্ঠতার প্রাক মুহূর্তে তার স্ত্রী গ্রিট-কে সতর্ক করে দেয়, ‘মনে রেখো, দর্শক কিন্তু দেখছে।’ কখনো সরাসরি দর্শকদের দিকে তাকিয়ে কথা বলে।
সাক্ষাৎকারের একেকটা শটের মাঝখান থেকে কিছুটা বাদ দিলে যে একটা এফেক্ট হয় (জাম্প কাট) সেটা বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। সাউন্ড নিয়ে চলেছে পরীক্ষা নিরীক্ষা।
ফিল্মের শেষে আদিনা বলছে, ‘ঘনিষ্ঠতা বিষয়ে যে ধারণা নিয়ে শুরু করেছিলাম এখন সেখানে কত রকম শেড!’ ইত্যাদি।
টাচ মি নট একটি চূড়ান্ত দার্শনিক ছবি।
আদিনা দারুণ দক্ষতায় নির্মাণ করেছেন ফিল্মটি। হ্যাটস্ অফ।

দ্য জাজমেন্ট ডে ছবিতে আবু বকর শাওকি সুস্থ হয়ে যাওয়া এক কুষ্ঠ রোগীকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে তাঁর কাহিনি সাজিয়েছেন।
বিশাই নামের লোকটি লেপ্রসি আক্রান্ত হওয়াতে খুব ছোটবেলায় পরিবারের লোকেরা তাকে পরিত্যাগ করে। সে আশ্রয় পায় এক বস্তিতে। যেখানে ভালো খারাপ সবাই তার আপনজন। এখানেই সে জঞ্জালের পাহাড় থেকে বিক্রয়যোগ্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করে। এখানেই কুড়িয়ে পায় একটা পরিত্যক্ত ওয়াকম্যান ও অডিও ক্যাসেট। জিনিসপত্র গাধার গাড়িতে চাপিয়ে বিক্রি করতে নিয়ে যায়।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর সে একদিন নিজের পরিবার খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। গাধায় টানা গাড়িতে সব মালপত্র নিয়ে।
তার সঙ্গে জুটে যায় অনাথ বালক ওবামা।
রাস্তায় তারা দুজনে কতরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। এতদিন যেখানে তারা বসবাস করতো তার বাইরের পৃথিবী তাদের কাছে ছিল অচেনা।
নীলনদে নেমে বিশাই স্নান করে কতদিন পরে। তার জীবনে জলও যে সহজলভ্য নয়।
এই নতুন পৃথিবীতে অসম বয়সী দুজন মানুষ প্রত্যাখ্যাত হয় বেশি, গৃহীত হয় কম। কখনও একদল ভিখারির কাছে, কখনো মসজিদে তারা আশ্রয় পায়। পরিবারের লোকদের খুঁজে বের করলেও সেখানে সে স্বাগত নয়।
আবার জঞ্জালের স্তূপেই ফিরে আসার সদ্ধান্ত নেয় দুজন। ওবামা শহরে থেকে যেতেই পারতো। কিন্তু বিশাইকে সে বড্ড ভালোবাসে। তার সঙ্গেই সে ফিরে যেতে চায়।
এইসব অন্ত্যজ মানুষও ফিল্মের কেন্দ্রীয় চরিত্রে জায়গা পাচ্ছে। আধুনিক বিশ্ব ঝাঁ চকচকে জীবন থেকে চোখ সরিয়ে এদের দিকেও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে বাধ্য হচ্ছে।
এর থেকে আশার কথা বোধহয় আর কিছু হতে পারে না।

বিশ্বের সবথেকে তরুণতম পরিচালক জঁ লুক গদার।
তাঁর নতুন নতুন ভাবনায় এখনো বিশ্ব অভিভূত। দ্য ইমেজ বুক সেই তারুণ্যের শেষতম দৃষ্টান্ত।
কোন পৃথিবীর দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি? চারপাশে শুধুই ইমেজ। টেলিভিশন, ইন্টারনেট, নতুন নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, হাতে হাতে স্মার্ট ফোন- সবই ইমেজ। যেদিকে তাকাও। ইমেজ। এটা কি এক ধরনের সন্ত্রাস? আমরা কি তারই শিকার হচ্ছি?
সঙ্গে আছে রক্তাক্ত সন্ত্রাস।
আমরা কি তাহলে আর এক আউসভিৎস-এর দিকে এগোচ্ছি?
দ্য ইমেজ বুক-এ পরিচালক ব্যবহার করেছেন বিখ্যাত সব পেন্টিং, রেকর্ডেড ভয়েস, সিনেমার ক্লিপ, আইসিস-এর ভিডিও, মোবাইলে তোলা শর্ট ভিডিও, টেক্সট ইত্যাদি।
শুরুর দিকেই দেখা যাচ্ছে অঁসিয়ে অদালু ফিল্মের সেই বিখ্যাত চোখ তুলে নেওয়ার দৃশ্যের খণ্ডাংশ। আসে গুস্তভ ক্লিম্পট-এর চিত্রশিল্পের সোনায় মোড়া, সবকিছু ঠিকঠাক জীবনে অশ্রুও সোনা হয়ে যাওয়া চিত্রটি; গগাঁ-র তাহিতি দ্বীপের মেয়ে। পাসোলিনির আরব রজনীর দৃশ্য পরিচালক ব্যবহার করেন একাধিক বার। সময় নিয়ে।
বেশ কিছু ফিল্ম ও চিত্রশিল্প চেনা গেলেও সব চেনা সম্ভব হল না। পরিচালক চান না দর্শক তাঁর আর্ট ফর্ম সহজে বুঝে যাক।
তিনি পর্দায় প্রতিফলিত ইমেজের ফ্রেম রেসিও পাল্টে দিয়েছেন বার বার। যদিও স্মার্ট ফোনের লম্বাটে রেশিও দেখলাম না। রোটেট করে স্মার্ট ফোনের ইমেজকে সিনেমার পর্দার আকার দেওয়া যায় বলেই হয়তো।
ইমেজগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কালার স্যাচুরেটেড, কখনো ওভার এক্সপোজড, কখনো ব্লিঙ্ক করছে, কখনো বৈদ্যুতিক ওয়েভের মতো কিছু লাইন ইমেজের ওপর স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। একটা ইমেজ থেকে ছটপট করতে করতে এসে পড়ছে একের পর এক ইমেজ।
কখনো বা ইমেজ বলতে পর্দা জুড়ে শুধুই কালো। চলছে ভয়েস ওভার।
কখনো লেফটে ভয়েস ওভার শোনা যাচ্ছে তো কখনো রাইটে। কখনো বা লেফটে একটা রাইটে একটা, একসঙ্গে দুরকম ভয়েস। তার মধ্যে গদারের নিজের ভয়েসও আছে। কখনো ভয়েস হয়ে যাচ্ছে ডিসটরটেড।
মিউজিক চলতে চলতে ফেড আউট ছাড়াই কট্ করে কেটে যাচ্ছে। কখনো বাখ বেজে উঠছে তো কখনো মিউজিকের মন্তাজ। কখনো মিউজিকও কিম্ভূত কিমাকার।
লিপ সিঙ্কে প্রায় নেই কোনো সংলাপ বা নেই সিঙ্ক সাউন্ডও। অথচ আছে সাউন্ডের দুর্নিবার ব্যবহার।
ফিল্মটি তিনটি ভাষায়; ইংরেজি, ফরাসি, আরবি।
টেক্সট ইমেজ ব্যবহার করছেন তিনি, ব্যবহার করছেন বই পড়া বা বই-এর ক্লিপিংস।
আর এখানেই মজা হল। শেষ হয়ে গেছে ভেবে কোনো এক দর্শক হাততালি দিয়েই সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলেন। হলে বেজে উঠলো শেষের বেল। জ্বলে গেল লাইট। দর্শকদের অনুরোধে লাইট বন্ধও হল।
ফিল্মের একটা জায়গায় সাউন্ড শোনা যাচ্ছে না, অথচ সাবটাইটেল আসছে মাঝে মাঝে। এটা গদারের কেরামতি না যান্ত্রিক ত্রুটি বোঝা গেল না। যতই হোক, গদারের ফিল্ম। দর্শক চেঁচাতে পারলেন না।’e