
কর্নাটকে কী হতে চলেছে তা বুঝতে কারওরই অসুবিধা ছিল না। স্বাভাবিক সম্ভাবনা অনুযায়ী বিজেপি পরিষদীয় দলনেতা বিএস ইয়েদিয়ুরাপ্পা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। রাজ্যপাল বিজেপিকে সরকার গড়ার আমন্ত্রণ জানানোয় বিরোধীরা সংবিধানের কণ্ঠরোধের অভিযোগ তোলেন। বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেস শেষ রাতে আদালতের দরজাতেও হাজির হয়। কিন্তু আদালত ইয়েদিয়ুরাপ্পার শপথের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই আদালতে এ নিয়ে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালদের অতীতের অনুসৃত প্রথার কথাও তুলে ধরা হয় বিপরীত পক্ষের তরফ থেকে। তা ছাড়া আইনমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ বলেন, আদালত কর্নাটকের জনাদেশকেই সম্মান জানিয়েছে। গণতন্ত্রে এটাই স্বাভাবিকতা। রবিশংকরের কথায় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থাকা অস্বাভাবিক নয়। স্বাভাবিক ভাবেই তা রীতিমতো স্পষ্ট। কারণ, কর্নাটকে জনাদেশ তেমন স্পষ্ট নয়। বলা যেতে পারে রাজ্যের জনতা স্পষ্ট জনাদেশ না দিলেও বিচ্ছিন্ন ভাবে একটা মতামত ব্যক্ত করেছেন। কর্নাটকের জনগণ রাজ্যের ক্ষমতাসীন সিদ্দারামাইয়া সরকারকে স্পষ্টতই খারিজ করেছেন। এর ব্যাখ্যা হতেই পারে, রাজ্যের মানুষ শক্তশালী বিরোধীপক্ষ চেয়েছেন, যাতে সরকারকে প্রতি মুহূর্তে লাগাম দেওয়া যায়। আর এর পাশাপাশিই বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজ্যের জনগণের মধ্যে গরিষ্ঠ অংশ মতাদর্শগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে রায় দিয়েছেন। তাঁরা কংগ্রেস ও জেডি(এস) নেতৃত্বকে শিক্ষা দিতে চেয়ে রাজ্য রাজনীতির স্টিয়ারিং তাদের হাতে তুলে না দিয়ে নিজেদের হাতেই রেখেছেন। ঘোষিত ভাবে বিজেপি-বিরোধী এই দুই দলের দাসত্ব না করে যেখানে যে বিজেপিকে হারাতে সক্ষম তাকেই বেছে নিয়েছেন। প্রতীকের তোয়াক্কা করেননি। কারণ জনগণ সমমতাবলম্বীদের যে মোর্চা চেয়েছিলেন, কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী ও সিদ্দারামাইয়ারা এবং জেডি(এস)-এর কুমারস্বামী অ্যান্ড কোং তাতে কান দেননি। দলীয় সংকীর্ণতা ও মুখ্যমন্ত্রিত্বের গদির মায়া ছাড়তে পারেননি। তাই দুই দলকেই জোট বাঁধার বার্তা দিয়ে যথাক্রমে ৭৮ ও ৩৮টি আসন দিয়েছেন জনগণ।
ভোটের আগে মানুষের মন বুঝতে অপারগ কংগ্রেস এক আসনে মুখ্যমন্ত্রী এবং বেশ কিছু আসনে রাজ্যের মন্ত্রীদের হারিয়ে বিধানসভায় বৃহত্তম দলের মর্যাদাও রাখতে না পেরে শেষ পর্যন্ত দেওয়ালের লিখন দেখেছে। তা-ও রাজ্যের বা সর্বভারতীয় নেতৃত্বের হুঁশ হয়নি ভোটের পরেও। অন্য বিরোধীদের সঙ্গে কথা বলে প্রাক্তন সভানেত্রী সনিয়া গান্ধী শেষ পর্যন্ত রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন। তাঁরই নির্দেশে রাহুলের মালুম হয় পরামর্শদাতারা কী ভাবে ভুল পথে চালিত করেছেন দলকে। সনিয়ার বার্তা নিয়ে বেঙ্গালুরু পৌঁছে প্রবীণ নেতা গুলাম নবি আজাদ আগাম ঘোষণা করেন, দেবগৌড়ার ছেলে ও জেডি(এস) নেতা কুমারস্বামীকেই মুখ্যমন্ত্রী করে ধর্মনিরপেক্ষ জোট গড়া হোক। সেইমতো রাজ্যের জোট নেতারা রাজ্যপালের কাছে গিয়ে বিধায়কদের তালিকা-সহ সরকার গড়ার দাবিপত্র পেশ করেন। এ দিকে বৃহত্তম দলকেই সরকার গড়ার প্রথম সুযোগ দেওয়ার সাংবিধানিক নজির দেখিয়ে দাবি রাখেন ইয়েদিয়ুরাপ্পা। পালটা কংগ্রেস-জেডি(এস) বলে, গোয়া-মণিপুর-মেঘালয়ে কংগ্রেস বৃহত্তম দল হওয়া সত্ত্বেও তো ভোট-পরবর্তী জোটের নেতাকেই সরকার গড়তে ডাকা হয়েছে। তা হলে কর্নাটকেও কুমারস্বামীকে ডাকা হবে না কেন? উল্লেখ্য, এর পালটা বিজেপি যা বলে সে কথাই তিন রাজ্যে বলেছিল কংগ্রেস।

কিন্তু রাজ্যপালের ভূমিকা যা হওয়ার কথা তা-ই হয়েছে। রাজ্যপাল সাংবিধানিক ভাবেই কেন্দ্রের প্রতিনিধি। রাষ্ট্রপতির প্রসন্নতা অনুযায়ী তিনি কাজ করেন। এবং রাষ্ট্রপতি কাজ করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মাধ্যমে। সুতরাং কেন্দ্রের শাসকের সঙ্গে রাজ্যপালের কর্মপন্থা থাকে এক সুরে বাঁধা। তাই কর্নাটকে যা ঘটল তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অতীতে অসংখ্য বার রাজ্যে রাজ্যে পালাবদল হয়েছে বা হয়নি কেন্দ্রে আসীন কংগ্রেসের অঙ্গুলিহেলনে। বর্তমানে ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার কৌশলও রচিত হয়েছে ও হচ্ছে এক কালের সর্বশক্তিমান কংগ্রেসেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এবং কোয়ালিশনের রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ কংগ্রেস এ বিষয়ে তুলনায় বেশি পরিণত বিজেপির অনুকরণ করতে চাইলেও পেরে উঠছে না। কোয়ালিশনের রাজনীতি করতে হলে যে দলীয় সংকীর্ণতা দূর করে কিছুটা ছাড়ার মানসিকতা চাই তা অনেক ক্ষেত্রেই আত্মস্থ করতে অপারগ কংগ্রেস। জোট সরকার হবে অথচ কংগ্রেস নেতৃত্বে থাকবে না, এমন সূত্র মেনে নিতে অভ্যস্ত নয় অর্ধশতকের শাসকদল। এই সব কারণেই স্পষ্ট জনাদেশ না পেয়েও রাজ্যের সরকারে আসীন হওয়ার চেষ্টা করেছিল বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন ইয়েদিয়ুরাপ্পা। এক দিকে মেরুকরণের পরিস্থিতি এবং অন্য দিকে লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের প্রভাবের অস্ত্রে, রাজ্যে সুস্থিতি প্রতিষ্ঠার যুক্তিতে আস্থাভোটে উতরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন ইয়েদিয়ুরাপ্পা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আস্থাভোটে না গিয়ে ৫০ ঘণ্টা পর ইস্তফা দিলেন। মনে পড়ে যায় ২২ বছর আগের কথা। ১৯৯৬-এ রাষ্ট্রপতি শংকরদয়াল শর্মা অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সরকার গড়তে ডাকেন বৃহত্তম দলের নেতা হিসাবে। বিরোধী জোটের অন্যতম নেতা মুলায়ম রাষ্ট্রপতিকে সুরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। কিন্তু শর্মা বলেছিলেন, বৃহত্তম দলকেই প্রথম সুযোগ দেওয়াটা সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শোভনতা। মোদ্দা কথা, শর্মার সিদ্ধান্তে শ্যাম আর কূল দুই-ই রক্ষা হয়েছিল। কারণ সাংবিধানিক শোভনতায় প্রথম বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু ওই ঘটনার ফলে বিরোধী জোট যে ব্যাপকতা পেয়েছিল তার পরিণামেই তেরো দিনের সরকারের পর কেন্দ্রে রাজত্ব করেছিল দু’ বছরের যুক্তফ্রন্ট সরকার, যারা কংগ্রেসকেও অভ্যস্ত করেছিল কোয়ালিশনে।