
বিরোধী শিবিরে জোটের ভেতর জোট গড়ার প্রবণতা বিজেপির কতটা উপকার করতে পারে তার লিটমাস টেস্টের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ছত্তীসগঢ়ে বিধানসভা ভোটের ফলাফল বলে দেবে তৃতীয় শক্তির অভ্যুদয়ে বিজেপি ফায়দা পেল কিনা, এবং পেলেও কতটুকু পেল। এই বাস্তবতা সম্পর্কে সমস্ত সংশয় কেটে গেলে বিরোধী দলগুলো হয় নিজেদের ধ্যানধারণা বদলাবে, না হয় পরিস্থিতির চাপে পড়ে অবস্থা বুঝে রণনীতি সংশোধন করবে। কারণ, বিজেপির প্রস্তাবিত মেরুকরণের বাস্তবতা বুঝতে পারলে তাদের এ কথাও মানতে হবে যে, মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় তৃতীয় কোনো স্থান নেই। তৃতীয় স্থানে যে বা যারা থাকবে তারা প্রথম স্থানাধিকারীকেই পুষ্ট বা শক্তিশালী করে রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নেবে। মেরুকরণের এই অমোঘ সূত্র অক্ষরে অক্ষরে কার্যকর হয়েছিল ২০১৪-র লোকসভা ভোটে, উত্তরপ্রদেশে। বহু বার, বহু ক্ষেত্রে এমন প্রমাণ প্রকট হয়েছে। উল্লেখিত ঘটনাটি সাম্প্রতিক ও সব চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। বৃহত্তম প্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের ভেতর ৭৩টিই দখল করেছিল বিজেপি জোট। ৫টি পেয়েছিল সমাজবাদী পার্টি এবং কায়ক্লেশে ২টি পেয়ে মুখ রক্ষা হয়েছিল কংগ্রেসের দুই মাস্তুল সনিয়া ও রাহুলের। আর বহুজন সমাজ পার্টি একেবারে মুছে গিয়েছিল। তাদের দলিত ভোট মেরুকরণের মন্ত্রবলে সবটাই শুষে নিয়েছিল বিজেপি।
আরও পড়ুন এসে গেছে অচ্ছে দিন, আম আদমি বুঝে নিন
এই ঘটনা থেকে অনেকটাই শিক্ষা নিয়েছে কংগ্রেস। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ও কৌলীন্য হারিয়ে কংগ্রেস বুঝেছে, বিরোধী শিবিরের ফাটলই বিজেপির নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার চাবিকাঠি। ওই ফাটল দিয়েই তারা সরকারে মাথা গলিয়েছে। সুতরাং বিজেপিকে হারাতে হলে সমস্ত ছোটোখাটো স্বার্থ ছাড়তে হবে। মতাদর্শের লড়াইয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থ দেখা চলবে না। কারণ, মতাদর্শের লড়াইয়ে ভোটারদের কাছে দ্বিতীয় কোনো অপশন থাকে না। সে শুধু দেখে, মূল প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানোর মতো শক্তি কোন দলের আছে। এবং কোন দলকে একই কারণে সব ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতের ভোটার ভোট দেবে। এই সূত্র অনুযায়ীই মায়াবতীকে নিঃস্ব করে তাঁর দলিত ভোটার বৃহত্তম লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে ভেবেছেন বিরোধী ভোট অটুট রাখা জরুরি। এ জন্যই কোথাও সপা, কোথাও কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। তার কাছে বেঁচে থাকার অগ্রাধিকার সব চেয়ে বেশি।
সমর্থক, ভোটারদের এই পরিণত ভাবনা বিরোধী শিবিরের নেতাদেরও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ করতে বাধ্য করছে। উত্তরপ্রদেশে এই কারণে তিনটি লোকসভা আসনের উপনির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধীদের প্রার্থীদের জয়ী করেছে মানুষ। গোরখপুরের মতো গেরুয়া দুর্গেরও পতন হয়েছে। কখন এই পতন সম্ভব হল? যখন ভারতের মধ্য গগনে মোদী এবং লখনউয়ের তখতে আসীন হিন্দু রাষ্ট্রের নমুনা–শাসক। বাতিল সাইকেল আর কাদায় পড়া হাতির দাপটে যে পদ্মপুকুর তোলপাড় হতে পারে ২০১৮-তেই, তা কেউ কল্পনাও করেনি। আসলে তথাকথিত উঁচু জাত, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে এক হয়েছে শোষিত, অপমানিত, অনগ্রসর-দলিত–সংখ্যালঘু। এই ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচের অনিবার্য লড়াই রুখে দিতেই ৮৫% হিন্দু আর ১৫% মুসলমানদের লড়িয়ে দিতে চায় সাম্প্রদায়িক অন্ধকারের শক্তি। আসলে এরাই সংখ্যালঘু। এই মুষ্টিমেয়র শাসন চিরস্থায়ী করতেই হিন্দুত্বের ফরমুলা। যার সঙ্গে হিন্দু সংস্কৃতির দূরাগত সম্পর্কও নেই। হিন্দি বলয়ের মানুষের সমীকরণ তাই প্রস্তুত। পাশাপাশি পূর্ব ভারতের প্রত্যাঘাত তো সময়ের অপেক্ষা মাত্র। উত্তর পূর্বাঞ্চলের অসম, ত্রিপুরায় নতুন কায়েম হওয়া বিজেপি-রাজ সম্পর্কে আম জনতার মোহভঙ্গ শুরু হয়েছে বেশ কিছু দিন। ভিন্ন রাজনীতিতে বিশ্বাসের পরিণাম মারাত্মক। সদ্যই পাঁচ বাঙালির গুপ্তহত্যা মানুষের ঘুম কেড়েছে। ওডিশায় এখনও অনিশ্চিত বিজেপি। এবং বিহারের মানুষ অপেক্ষা করছে নির্বাচনের জন্য। পালটা মেরুকরণ সম্পূর্ণ। এই অবস্থায় বিরোধী পক্ষের ভেতরে ঘুঁটি সাজিয়ে রেখেছে শাসকদল। পূর্বাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চল, সর্বত্রই ভেকধারী কেউ কেউ বিজেপির স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছেন বিরোধী শিবিরে বসে। নিজের খেলা পণ্ড হলে এদের সাহায্য নেবে বিজেপি, ধর্মনিরপেক্ষ জোটে ভাঙন ধরাতে। মূল বিরোধী দলের নেতৃত্বকে রুখতে। কিন্তু কিছু ভুল সংকেতের দরুণ এই ভেক ধরা পড়ে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পিছু হঠতে হয়েছে ষড়যন্ত্রকে। কর্নাটকে সফল হয়েছে বিরোধী জোটের পরীক্ষানিরীক্ষা।