
শেষ পর্যন্ত আরও একবার পাক ফৌজের ইচ্ছাপূরণ হল। নওয়াজের দল পরাস্ত। বিলাবল তৃতীয়স্থানে। এবং ২২ বছর ধরে কাঠখড় পুড়িয়ে ২২ গজের ইমরান খান ‘পয়গম্বর’ হলেন ইসলামাবাদের তখতে। বিরোধীরা আওয়াজ তুলেছেন ভোটে ব্যপক রিগিংয়ের বিরুদ্ধে। ‘সব ঝুঠ হ্যায়’ বলে ইমরানের পক্ষে ঢাল ধরেছে ফৌজ। ভোটে জিতেই ভারতকে বার্তা দিয়েছেন টিম পাকের নয়া ক্যাপ্টেন। বার্তা শুভেচ্ছার।
যদিও ক্রিকেট আর রাজনীতি যে কতটা আলাদা তা কালে কালে বুঝতে হবে ইমরানকে। জানতে হবে, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নিষিদ্ধ বস্তু। চাই হাজার বছর ধরে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করার ঘোষণা। যা করেছিলেন আধুনিক পাকিস্তানের সবচেয়ে বিতর্কিত ও জনপ্রিয় নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো। অবশ্য ও কথা বলেও পার পাননি।ফৌজি শাসক জিয়াউল হক জমানার কোর্ট ভুট্টোকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছিল। কারণ প্রচণ্ড ভারতবিরোধী লাইনের পাশাপাশিই দু’দেশের ঐতিহাসিক দ্বিপাক্ষিক সিমলা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে ভারতে এসেছিলেন ভুট্টো।

অন্যদিকে ভারতের রাজীব গান্ধী জমানায় পাক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকন্যা বেনজির ভারতের সঙ্গে মৈত্রী গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের শিকড় উপরে ফেলার প্রক্রিয়ায় আততায়ীর হাতে মরতে হল তাঁকে, তার আগেই আর এক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজকে মূল্য দিতে হয়েছিল পাক-ভারত লাহোরসনদ স্বাক্ষর করায় ও দিল্লি-লাহোর বাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে স্বাগত জানানোয়। লাহোরে সেই স্বাগত জানানোর সভা ও যৌথ সনদ স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান বয়কট করেছিলেন সে সময়ের পাক সেনাপ্রধান পরভেজ মুশারফ। বাজপেয়ীকে স্বাগত জানানোর পাল্টা নওয়াজকে গদিচ্যুত করে কারগিলে সেনা ঢুকিয়ে বুঝিয়ে দেন পাক সেনাবাহিনী কী চায়। আর যুগে যুগে পাক শাসকদের সেটাই ম্যানডেট। জনণণের মধ্যে শুভশক্তির কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। ভারত-বিরোধিতার উগ্র জিগিরে তা চাপা পড়ে যায়। ভারতে গণতন্ত্রের ভিত অনেক মজবুত। তবু পাকিস্তানের অবস্থান অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের জনসাধারণের মধ্যে বড় অংশকে উগ্র জাতীয়তার জলাজমিতে ঠেলে দেয়।।আর সেই জমি তেই অনায়াসে ফসল ফলায় ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কুশীলবরা।
…পাকিস্তানে এই ধরনের সংস্কৃতি নেই বলেই ফৌজের কথাই শেষ কথা। তাই ইমরান প্রথম বার্তায় যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তা ক্যান্টনমেন্টের অনুমোদন পাবে না। ইমরান শান্তি সহাবস্থানের পথে গেলে তাতে অবশ্যই কাঁটা বিছিয়ে দেবে ফৌজ। তাতেও বাগে আনা না গেলে তাঁকেও সরিয়ে দিতে সময় নেবে না।…
বাজপেয়ী জমানা শেষ হয়েছিল লাহোর , কারগিল, পোখরান, আগ্রার উত্থান-পতনের পর ইসলামাবাদে মুশারফের সঙ্গে চুক্তিতে।প্রমাণ হয়েছিল, পরমাণু যুদ্ধ নয়, কূটনীতির টেবিল থেকেই পাওয়া যায় শান্তি ও সমাধানের, প্রগতি ও সহাবস্থানের সূত্র। বিদেশনীতির আঙিনায় ভারতের এই তুলনামূলক পারদর্শিতাকে মাথায় রেখেই মনমোহন সিংয়ের ১০ বছর শাসনকালে ভারত দাপট দেখিয়েছে আন্তর্জাতিক মঞ্চে। সীমান্তে উত্তেজনা, কাশ্মীর পরিস্থিতির চাপ সত্ত্বেও আর কারগিলের মতো অবস্থা বা সংসদে জঙ্গি হামলার ঘটনা ফিরে আসেনি। শেষ পর্যন্ত ২৬/১১-র ঘটনায় আরও কোণঠাসা হয়েছে ইসলামাবাদ। পাক-বিরোধিতার আ্যজেন্ডাকে কোর আ্যজেন্ডার জায়গা দেয়নি ইউপিএ। এবং একইসঙ্গে পাকিস্তানের মাটিতে পাও রাখেননি মনমোহন তাদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য চাপ দিতে।

মোদী পয়লা দিনেই বদলে দিলেন ভারতের কূটনৈতিক নীতির কলকৌশল।নওয়াজ শরিফকে ডেকে আনলেন শপথে। এবং তারপর আচমকাই নাটকীয়ভাবে লাহোরে নওয়াজের পারিবারিক অনুষ্ঠানে পাক প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির অন্দরমহলে উপস্থিতি। সমস্ত দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়ায় জল ঢেলে, দাউদ থেকে হাফিজ সঈদ পর্যন্ত অপরাধীর শাস্তির দাবি কার্যত মুলতবি করে দিয়ে উদার হতে চাইলেন মোদী। কারণ তখন মনমোহনকে দুর্বল প্রধানমন্ত্রী চিত্রিত করার পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তার তত্ত্ব পরিবেশন করে ভোট কুড়নোর পর্ব শেষ। নরমপন্থাকে নস্যাৎ করারই পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন তিন দশকে প্রথম নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা। সুতরাং তখন উদার হতে বাধা কোথায়।

যদিও নওয়াজের ঔদার্য সহ্য করেনি পাক ফৌজ। এবং শেষপর্যন্ত গদি তো বটেই, ভোট রাজনীতি থেকেও নির্বাসিত হতে হয়েছে। অনেকটা লালুপ্রসাদের মতো। এবং মুসলিম লিগ ও পিপলস পার্টিকে কোণঠাসা করার সুযোগ পেয়েছে ফৌজ সাধারণ রাজনীতিবিদদের প্রতি জনমানসে অনাস্থার সুবাদে। ভারতেও এই পরিস্থিতি কট্টরপন্থাকে পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছে। তবে ভারতে গণতন্ত্রের শিকড় অনেক মজবুত এবং সামরিক বাহিনী যথার্থ শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আস্থাশীল। ফলে, কট্টরপন্থা পল্লবিত হতে পারে না। পাকিস্তানে এই ধরনের সংস্কৃতি নেই বলেই ফৌজের কথাই শেষ কথা। তাই ইমরান প্রথম বার্তায় যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তা ক্যান্টনমেন্টের অনুমোদন পাবে না। ইমরান শান্তি সহাবস্থানের পথে গেলে তাতে অবশ্যই কাঁটা বিছিয়ে দেবে ফৌজ। তাতেও বাগে আনা না গেলে তাঁকেও সরিয়ে দিতে সময় নেবে না। বসাবে প্রার্থিত বিকল্প কাউকে, যেমন হাফিজ সঈদ।