প্রসিত দাস
আজ থেকে ঠিক একশো তিরিশ বছর আগে, ১৮৮৭ সালের ১ ডিসেম্বর প্রথম বার পাঠকদের সামনে হাজির হয়েছিলেন শার্লক হোমস। বিটনস ক্রিসমাস অ্যানুয়াল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল আর্থার কোনান ডয়েলের প্রথম হোমস উপন্যাস ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’। বই হিসেবে প্রকাশিত হয় পরের বছর। কোনো রয়্যালটি নয়, লেখক পেয়েছিলেন থোক ২৫ পাউন্ড। এর পর থেকে সব হোমস-কাহিনিই অবশ্য প্রকাশিত হয় স্ট্র্যান্ড পত্রিকায়। এখানেই সিডনি পেজেটের অলংকরণে অমর হয়ে ওঠেন হোমস ও ওয়াটসন। প্রথম হোমস-কাহিনি ছাপা না হলে যে পত্রিকার নামও কেউ মনে রাখত কিনা সন্দেহ, ২০১০ সালে সেই বিটনস ক্রিসমাস অ্যানুয়াল-এর ওই বিশেষ সংখ্যাটির একটা কপির দাম উঠেছিল ১,৫৬,০০০ ডলার! তা যে শেক্সপিয়রের প্রথম ফোলিও সংস্করণের থেকেও বেশি দুর্লভ।
সাহিত্যের প্রথম গোয়েন্দা নন হোমস। এডগার অ্যালান পো-র দুপ্যাঁ ও এমিল গ্যাবোরিও-র মঁসিয়ে লেকক তাঁর পূর্বসুরি। কিন্তু তিনিই যে সাহিত্যের জনপ্রিয়তম গোয়েন্দা সে কথা চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। আর সব চেয়ে বিখ্যাত চরিত্র? হ্যামলেট, ডন কিহোতে কেউই কি পেরেছে হোমসের জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিতে?

হোমস-কাহিনি লিখতে লিখতে বিরক্ত কোনান ডয়েলের হাতে ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ গল্পে হোমসের মৃত্যু, তার পর পাঠকদের প্রবল চাপে তাদের প্রিয় গোয়েন্দাকে আবার ফিরিয়ে আনা, এ সব গল্প তো সকলেই জানেন। ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ পত্রিকায় ছেপে বেরোনোর পর কুড়ি হাজারেরও বেশি পাঠক স্ট্র্যান্ড পত্রিকার গ্রাহকপদ ছেড়ে দেন। এ রকম নজির বিশ্ব সাহিত্যে আর আছে কি? শুধু তা-ই নয়, ২২১ বি, বেকার স্ট্রিটের থেকে বেশি বিখ্যাত কোনো কাল্পনিক ঠিকানাও কি আর আছে?
আর ভাববেন না যে এই জনপ্রিয়তা অতীতের ব্যাপার। এখনও পর্যন্ত বড়ো পর্দায় এই গোয়েন্দার কীর্তিকলাপ নিয়ে হওয়া ছবির সংখ্যা ৪৬। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসেও মুক্তি পেতে চলেছে ‘হোমস অ্যান্ড ওয়াটসন’ নামে একটি ছবি। এর সঙ্গে টেলিভিশন ধারাবাহিক যোগ করলে সংখ্যাটা একশোর কাছাকাছি চলে যাবে। আর বিবিসি-র ‘শার্লক’ সিরিজ তো এই হালের ব্যাপার (এই শার্লক অবশ্য একেলে শার্লক)। বিবিসি-র প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, এই টেলিভিশন সিরিজে লন্ডনের যে বিশেষ ক্যাফেটিতে হোমস-ওয়াটসনের আড্ডা সেখানে হোমস-ভক্তরা মাঝেমাঝেই ভিড় জমান। গোটা দুনিয়া জুড়েই রয়েছে হোমসের অনুরাগীদের অজস্র ক্লাব।
কোনান ডয়েলের পরেও আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে হোমস-কাহিনি লিখেছেন বহু লেখক। এর মধ্যে অ্যান্থনি হরোইৎজ-এর ‘মরিয়ার্টি’ বা ‘দ্য হাউজ অফ সিল্ক’-এর মতো উপন্যাস এখনও বেস্টসেলার। আর লরি কিং তো হোমসের বিয়েই দিয়ে দিয়েছেন মেরি রাসেল নামে এক যুবতীর সঙ্গে। তাকে প্রথম দেখা যায় ‘দ্য বিকিপার্স অ্যাপ্রেন্টিস’ উপন্যাসে। তুখোড় বুদ্ধিমতী এই মেরি সর্বার্থেই শার্লক হোমসের যোগ্য সহধর্মিণী। এই গোয়েন্দা-দম্পতির অভিযান নিয়ে লেখা শেষতম উপন্যাস ‘দ্য মার্ডার অফ মেরি রাসেল’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ সালে।
বাংলা সাহিত্যও এই গোয়েন্দাটিকে সমাদর জানাতে দেরি করেনি। সেই কবেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাই কুলদারঞ্জন রায় ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’ অনুবাদ করছিলেন ‘রক্ত সমীক্ষা’ নাম দিয়ে। পরশুরামের ‘নীল তারা’ গল্পেও হোমস-ওয়াটসনকে হাজির হতে দেখা যায়। আর প্রভাব? কোন কোন বাংলা গোয়েন্দা গল্পের প্লট হোমস-কাহিনির, যাকে বলে, ছায়া অবলম্বনে সেটা নিজেরাই ভেবে নিন না! সেটা অবশ্য হোমসের জনপ্রিয়তারই আরও একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ।
সাহিত্যের সব চেয়ে বিখ্যাত এই গোয়েন্দা ছাপার অক্ষরে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিলেন আজকের দিনেই।