দীধিতি ঘোষ :
শীতটা কিছুটা হলেও কমেছে। তবে হ্যাঁ, আসল গরম খবর তো অন্য জায়গায়। বইমেলায় এ বার অতিথি দেশ কোস্তা রিকা। সকলে ভূগোল নাও পড়তে পারেন। তাই বলা যায় কোস্তা রিকা মধ্য আমেরিকার, যার ভৌগোলিক আদানপ্রদান বেশ খানিকটা কলকাতার মতো। সে রকমই বললেন কোস্তা রিকার লেখিকা রোক্সানা পিন্তো। একটি ছোট্টো অবসরে। জিজ্ঞাসা করলাম, বুধবার সন্ধে সওয়া ছ’টা নাগাদ যেটা হল তা আপনার কেমন লাগল।
–কী ব্যাপার? কিছুটা হতচকিত হয়ে জিগগেস করলেন রোক্সানা।
—ওই যে হাতুড়ি ঠোকার ব্যাপারটা?
— ওহ, মজা পেয়েছি। দিদি যখন বললেন উদ্বোধনের প্রমাণ হাতুড়ি ঠোকা, তখন বুঝতে পারিনি। পরে সুধাংশুবাবু যখন দেখিয়ে দিলেন, তখন বুঝলাম ওটা করতে হবে আমাকেই। তবে দিদি নিজে ৪১ না গুণে ছাড়লেন না, পাছে আমার গুনতে ভুল হয়। আমার অঙ্কের জ্ঞানটা যে একটু কম। হাসছিলেন ত্রিদিববাবু।
— আপনার সদ্য প্রকাশিত বই, ‘ইদা ই ভুয়েলতা’র ব্যাপারে কিছু বলুন।
— ‘ইদা ই ভুয়েলতা’ মানে যাওয়া এবং ফিরে আসা। বিষয়টি একজন অঙ্কনশিল্পীর জীবনপঞ্জিকা। যেখানে তিনি নিজেকে নতুন ভাবে খুঁজে পান প্যারিসের রাস্তাঘাটে। প্যারিস ভ্রমণ একজনকে দেয় তাঁর চিন্তার উপাদান। দেয় বৈচিত্র্যময় খোরাক, যা তাঁকে বিভ্রান্ত করে, আশ্বাস দেয়, ভাবিত করে, জাগিয়ে তোলে এক অন্য আবেগ।
ইনি কি আপনারই এক রূপ? নাকি অন্য কেউ?
— বলতে পারেন। যে কোনো লেখিকাই কলমের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে থাকেন। আমি বহুবার প্যারিস গিয়েছি। এবং প্রত্যেক বারই এক নতুন দৃষ্টি ফিরে পেয়েছি। যে দৃষ্টি আমাকে প্যারিসের এক নতুন রূপ দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। ঘুরে বেড়িয়েছি এক জন বয়ঃসন্ধিপ্রাপ্ত মেয়ে হিসাবে প্যারিসের কোনায় কোনায়, এক জন পর্যটক হিসাবে নতুন কিছু দেখার আশায় একজন রাজনৈতিক দূত এবং একজন লেখিকা হিসাবে, যিনি ব্যস্ত অনুপঙ্খ নিরীক্ষণে।
তবে প্যারিসে কেন? কোনো বিশেষ কারণে?
— একেবারেই। ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্যারিসে ছিলাম। এবং তখনই কল্পনার দুয়ার আমায় বশ করে এক বিশেষ ভ্রমণপর্ব। ৩৩ বছর বয়স থেকে ফ্রান্সে ছিলাম শিল্পের চর্চায়। টানা ১৩ বছর। পরে নিজেকেই প্রশ্ন করতাম, সত্যিই কি আর কোস্তা রিকাতে ফিরে যাব? নাকি থেকে যাব এই নতুনত্বের মাঝে, এই উন্মাদ শহরে যেখানে থাকলে কখনও একঘেয়ে লাগে না।
— ফ্রান্সে থাকার সময় কোস্তা রিকার কথা মনে পড়ত না?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তুকে ব্যক্ত করলেন স্বচ্ছন্দে।
—- এক কথায় বলা যেতে পারে স্বদেশের স্নেহময়, মায়াময় স্মৃতি থেকে প্রবাসে নির্বাসপর্ব। আবার সেই প্রবাসই হয়ে ওঠে এক বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার কেন্দ্রস্থল, যেখানে খুঁজলে পাওয়া যায় মিশ্র অভিজ্ঞতার এক অভিনব স্বাদ। এবং সেটাও হয়ে ওঠে ভালোলাগা এবং ভালোবাসার দ্বিতীয় বাসস্থান। একাকিত্ব, কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। পৃথিবীর ‘গ্যাস্ট্রোনমিক ক্যাপিটাল’ প্যারিসের রসনাতৃপ্তি এবং আরও বহুবিধ অভিজ্ঞতার সম্ভারে সেই পরবাস হয়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ।
— তাহলে প্যারিস কি আপনাকে একেবারে নতুন করে দিয়েছিল?
— সেটা বলা যায় না। কারণ মনের ভিতরে স্বদেশের জন্য আশৈশব বিজড়িত সংস্কার এবং পরবাসের নব অভিজ্ঞতা, এই দুইয়ের সংঘাত একটা অস্তিত্বের টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছিল।
— আপনার সমস্ত অভিজ্ঞতার নির্যাস, এক কথায় পাঠকদের উদ্দেশে যদি বলেন।
— নতুন এবং পুরোনোর আত্মীকরণের মধ্যেই জীবনের চলমানতা। জীবন যাওয়া এবং আসার পুনরাবৃত্তি।
তাঁর মুখে মৃদু হাসি।