ঢাকা থেকে ফারুক ভূঁইয়া রবিন
পুরনো বছরের সব গ্লানি, অপূর্ণতা, বেদনা, অপ্রাপ্তি ঘুচে নতুনের আবাহনে আমাদের মাঝে আসে পহেলা বৈশাখ। নতুন বছরের আড়ালে সবাই খুঁজে বেড়ান স্বপ্ন, সম্ভাবনা, প্রত্যাশার নতুন সূর্য। আর সেই নতুন বছরকে বরণ করতে রাজধানী ঢাকা-সহ সারা বাংলাদেশ মেতে উঠে নতুন প্রাণের আবেশে। বৈশাখী আবেগের বিহ্বলতায় ডুবে যায় কোটি কোটি প্রাণ। পথে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে বর্ণিল মেলা-অনুষ্ঠানে মেতে উঠে প্রাণচঞ্চল বাঙালি। পহেলা বৈশাখ আসার কয়েক দিন আগে থেকেই চার দিকে শুরু হয় সাজোসাজো রব, রাস্তায় আলপনা এঁকে শুরু হয়ে যায় বৈশাখকে বরণের প্রস্তুতি।
পহেলা বৈশাখ মানেই রমনা বটমূলে বর্ষবরণ আয়োজন, পহেলা বৈশাখ মানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা, পহেলা বৈশাখ মানেই শহর পেরিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে সাংস্কৃতিক উৎসব।
নতুন বছরের প্রথম প্রত্যুষে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রমনার বটমূলে গান-কবিতার পসরা সাজিয়ে বসে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছায়ানট। পূব আকাশে নতুন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ’ গান গেয়ে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। প্রতিটি প্রাণেই বেজে উঠে ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা’। ঘণ্টা দুয়েকের এ পরিবেশনায় সুরের ধারায় বিমোহিত থাকেন হাজার হাজার মানুষ, প্রাণভরে উপভোগ করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, লালনগীতি।
পহেলা বৈশাখের উদযাপনের আরেক প্রধান অনুষঙ্গ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা। সব আঁধার, ধর্মান্ধতা আর উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বাধা ডিঙিয়ে আলোর পথে দেশ-জাতির এগিয়ে যাওয়ার শপথ আর মঙ্গল কামনায় বের করা হয় বর্ণিল এ শোভাযাত্রা। অজস্র মানুষের এই শোভাযাত্রায় প্রতিটি প্রতিটি প্রাণেই ধ্বণিত হয় শান্তি, সম্প্রীতি, মানবিক মূল্যবোধ জাগরণের প্রত্যাশা। শোভাযাত্রায় প্রতি বছরই একটি মূল প্রতিপাদ্য থাকে। এ বারের প্রতিপাদ্য হল ‘অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তরতর হে’। মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকে নানা ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম। এ সব প্রতীকী শিল্পের মাধ্যমে নানা বার্তা দেওয়া হয়। মঙ্গলের যাত্রীদের সেই শোভাযাত্রায় শোভা পায় রঙ-বেরঙের মুখোশ, বাঙালির সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা উপকরণ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি।
তীব্র খরতাপ উপেক্ষা করে রাজধানী জুড়ে পহেলা বৈশাখের প্রতিটি আয়োজনেই ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে অংশ নেন মানুষ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর, শেরেবাংলা নগর, কলাবাগান, সংসদ ভবন এলাকায় দিনভর সাংস্কৃতিক আয়োজন আর বৈশাখী কনসার্টে নামে মানুষের ঢল। পুরনো ঢাকার সদরঘাট, বাংলাবাজার, লালবাগ থেকে অভিজাত গুলশান, বনানী, উত্তরা — কাকডাকা ভোর থেকেই পুরো রাজধানীর পথ-ঘাট মেতে উঠে বৈশাখী আমেজে। পহেলা বৈশাখে ছুটির দিন থাকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান। রাজধানীর বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন ও অভিজাত ক্লাবগুলোতেও বৈশাখ উদযাপনে থাকে নানা আয়োজন।
যানজটের নগরীর চিরচেনা দৃশ্য এই এক দিনে আমূল বদলে যায়। বেশির ভাগ সময়ই থমকে যাওয়া গাড়ির চাকায় স্থবির নগরী এই দিনে রূপ নেয় প্রাণের উচ্ছ্বাসে। সবার পরনেই থাকে বাহারি নকশার পোশাক। মেয়েদের খোঁপায় শোভা পায় ফুল, গলায় মালা। শিশুদের কপালে টিপ ও পায়ে আলতা। বাঙালির এই প্রাণের উৎসবে ভিনদেশি নাগরিকদের অংশগ্রহণও দেখা মেলে। তাঁরাও বৈশাখী আমেজে মনোমুগ্ধকর, এই ঢাকার রাজপথে তাঁরাও সাজেন বাঙালি সাজে।
হাল আমলে পহেলা বৈশাখের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। পহেলা বৈশাখের এ বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন মহলে নানা কথাও হয়ে থাকে। তবে এ যদি এক দিক, অন্য দিক হল পহেলা বৈশাখে মানুষের ব্যাপক সম্পৃক্ততার অন্যতম বিজ্ঞাপন হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ। কারণ পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে ঘিরে মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের কারণেই তো বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্পনসরশিপের জন্য নিজে থেকে এগিয়ে আসছে।
রাজধানী ঢাকার বাইরেও বৈশাখ উদযাপনে কোনও কমতি থাকে না। দেশের প্রতিটি শহর-বন্দরে, গ্রামে-গ্রামান্তরে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় বর্ষবরণ উদযাপন করা হয়। ঢাকার বাইরেও মঙ্গল শোভাযাত্রা, রাখিবন্ধন, বর্ণাঢ্য র্যালি, পান্তা-ইলিশ ভোজন, ঢাক উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আনন্দঘন পরিবেশে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় মানুষ। ঢাকার বাইরে অনেক স্থানেই বৈশাখী মেলাগুলো কোথাও সপ্তাহব্যাপী, কোথাও ১৫ দিনব্যাপী আবার কোথাও মাসব্যাপী হয়ে থাকে। দেশ জুড়ে বৈশাখী মেলায় পরিবেশিত হয়ে থাকে যাত্রাপালা, নৃত্য, আবৃত্তি, বাউল গান, পঞ্চকবির গান, লোকগীতি, নাটক-সহ আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গ্রামের খোলা জায়গায় বসে জারি, সারি, মুর্শিদী, মারফতি, ভাওয়াইয়া গানের আসর। গ্রামীণ মেলা ভরে উঠে বাংলার নানা লোকশিল্পে, দেখা যায় কুটির শিল্পের নানা পসরা। গ্রামবাংলায় আয়োজন করা হয় নৌকা বাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তি, পুতুল নাচ, জাদু খেলা-সহ নানা খেলাধুলা। বৈশাখকে কেন্দ্র করে গ্রামে-গঞ্জের অর্থনীতিতেও নতুন প্রাণের সঞ্চার সৃষ্টি হয়। পুরনো বছরের হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে নতুন বছর উপলক্ষে আয়োজন করা হয় হালখাতা অনুষ্ঠান।
পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের পুরো আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে বর্ষবরণ উৎসব। পত্রপত্রিকায় পহেলা বৈশাখ নিয়ে নানা লেখা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। আর টেলিভিশনে দিনভর পহেলা বৈশাখের নানা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়ে থাকে। কখনও কখনও রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান, কখনও মঙ্গল শোভাযাত্রা আবার কখনও অন্য কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার। এমনকি ঢাকার বাইরে কোনও শহরে বরেণ্য শিল্পীদের সাংস্কৃতিক আয়োজনও সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে জাতীয় টেলিভিশনগুলো। এ ছাড়া দিনভর অন্য আয়োজন তো আছেই।
এই যদি হয় পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উৎসব, তবে আরেক দিক এর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্বরূপ। পহেলা বৈশাখ আবহমান কাল ধরেই গ্রামবাংলায় সামাজিক ভাবে পালিত হয়ে আসছে, তবে নাগরিক জীবনে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের গোড়ায় রয়েছে রাজনৈতিক চেতনা। বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের উৎসবের ব্যাপকতাও এসেছে রাজনৈতিক চেতনা উন্মেষের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান আমলে যখন বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, রবীন্দ্রচর্চার ওপর একের পর এক বাধা আসছিল, তখন পহেলা বৈশাখ উদযাপনকেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে নেওয়া হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকদের সব আগ্রাসী মনোভাব ও ষড়যন্ত্রের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে রূপ নেয় পহেলা বৈশাখ উদযাপন। স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ১৯৬৭ সালে নববর্ষ উদযাপনে প্রথম বারের মতো রমনার বটমূলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আয়োজন করে ছায়ানট। এর পর থেকে নববর্ষ উদযাপন, রমনার বটমূল আর ছায়ানটের অনুষ্ঠান যেন এক অন্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশেও বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন মৌলবাদীদের নিশানা হয়েছে। ১৪০৮ বঙ্গাব্দে (২০০১ সালে) রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার দগদগে স্মৃতি আজও মানুষ ভুলে যায়নি। মৌলবাদীদের সেই হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছেন। সেই হামলার পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু বাঙালির সেই প্রাণের উৎসব থেকে মানুষকে একবারের জন্যও দমাতে পারেনি মৌলবাদীরা। বরং যত দিন যাচ্ছে, বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মানুষের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে এ বারের পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বেশ কিছু বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। এ সব নিয়ে নাগরিক সমাজ ও সাংস্কৃতিক মহলে বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। নিরাপত্তাজনিত বিধিনিষেধের কড়াকড়িতে মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের চিরায়ত আমেজ যাতে কোনও ভাবে ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়টি নজরে রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে।
বাংলাদেশের জনজীবনে সব চেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব হল পহেলা বৈশাখ। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে বাঙালি জাতিসত্তাকে নতুন ভাবে জাগিয়ে তোলার বার্তা নিয়ে আসে বাংলা বর্ষবরণ। যখনই বাংলাদেশ কোনও সংকটে পড়েছে, পহেলা বৈশাখ তখন শুধু উৎসবের আমেজে না থেকে ওই সংকটের বিরুদ্ধে লড়ার শপথও শুনিয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ হিসেবে পহেলা বৈশাখ যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকুক বাঙালির হৃদয়ে, বাঙালির মননে।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।