বাংলাদেশ
ঢাকার পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরে হত্যাকাণ্ডের ১২তম বার্ষিকী পালন
হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যু বহাল রাখা হয়। ৮ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চার জনকে খালাস দেওয়া হয়।


ঋদি হক: ঢাকা
ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদর দফতরে বর্বরোচিত ঘটনায় নিহত সেনাসদস্যদের ১২তম শাহাদত বার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় পালিত হল। ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা-সহ ৭৪ জন নিহত হন।
বৃহস্পতিবার বনানীতে শহিদদের সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তাঁদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতির পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহউদ্দিন ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমেদ।
এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম আবু আশরাফ, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামালউদ্দীন উপস্থিত ছিলেন।
পুস্পস্তবক অর্পণ শেষে শহিদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা শহিদ সেনাসদস্যদের সম্মানে স্যালুট প্রদান করেন। পরে শহিদদের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ প্রার্থনা করা হয়।
এ দিন সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় মসজিদে শহিদদের আত্মার শান্তি কামনায় সকল স্তরের সেনাসদস্যদের উপস্থিতিতে মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।
অপর দিকে শহিদদের আত্মার শান্তি কামনায় পিলখানাস্থ বিজিবি সদর দফতর-সহ সকল রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় খতমে কোরআন, বিজিবি’র সকল মসজিদ এবং বিওপি পর্যায়ে প্রার্থনা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

এ ছাড়া দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে বিজিবি’র সকল স্থাপনায় বিজিবির পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং বিজিবি’র সকল সদস্য কালো ব্যাজ পরিধান করবেন।
এ উপলক্ষ্যে শুক্রবার বাদ জুম্মা পিলখানায় বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা সেক্টর মসজিদ এবং বিজিবি হাসপাতাল মসজিদে শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এম.পি। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, শহিদ ব্যক্তিবর্গের নিকটাত্মীয়, পিলখানায় কর্মরত সকল অফিসার, জুনিয়র কর্মকর্তা, অন্যান্য পদবির সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মচারীরা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রার্থনাসভায় অংশগ্রহণ করবেন।
বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে মামলা
পিলখানা হত্যা মামলার বিচার শেষ হলেও ১২ বছরেও বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার-কার্যক্রম শেষ হয়নি। মামলাটির বিচার চলতি বছরে শেষ হয়ে যাবে বলে রাষ্ট্রপক্ষ আশা প্রকাশ করেছে।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালতে হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করার পর ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল নিষ্পত্তি হয়। এ ঘটনার বিস্ফোরক আইনে করা মামলা এখনও বিচারাধীন।
রাজধানীর বকশিবাজারের সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে বিষ্ফোরক দ্রব্যের মামলার কার্যক্রম চলছে। এ মামলায় ১ হাজার ১৬৪ জনের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৮৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ ২৩ ফেব্রুয়ারি মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। ওই দিন পাঁচ জন সাক্ষ্য দেন।
আগামী ২৩ ও ২৪ মার্চ পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। মামলা সম্পর্কে প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, একই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার বিচার নিম্ন আদালতের পর হাইকোর্টেও নিষ্পত্তি হয়েছে। বিস্ফোরক আইনের মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। ১৮৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে চলতি বছরেই মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ করে আদালত রায় ঘোষণা করতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায়ে ১৫২ জন বিডিআর সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ২৫৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ২৭৮ জনকে খালাস দেওয়া হয়। রায়ের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যু বহাল রাখা হয়। ৮ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চার জনকে খালাস দেওয়া হয়। এ ছাড়াও একজনের মৃত্যু হয়। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময় কারাগারে থাকা দু’জন মারা যান। খালাস পান ১২ আসামি।
বাংলাদেশ
ভক্ত-সতীর্থদের চোখের জলে শেষ বিদায় কিংবদন্তি অভিনেত্রীকে
তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শনিবার অপরাহ্নে ঢাকার বনানীতে সমাহিত করা হয়।


ঋদি হক: ঢাকা
শোককাতর হাজারো ভক্ত এবং চলচ্চিত্রাঙ্গণের সতীর্থদের চোখের জলে বিদায় নিলেন বাংলার কিংবদন্তি নায়িকা সারাবেগম কবরী। সাবেক সাংসদ, সমাজসেবী, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং লেখক। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাও। ’৭১ সালে ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শনিবার অপরাহ্নে ঢাকার বনানীতে সমাহিত করা হয়।
ষাটের দশকে উর্দু ছবির দাপটে যখন বাংলা সিনেমার বেহাল অবস্থা তখন ১৯৬৪ সালে ‘সুতরাং’ তৈরি করেন সুভাষ দত্ত। আর তার নায়িকা ছিলেন কবরী। সেই সময়ের সুপারহিট ছিল চলচ্চিত্রটি। উর্দুওয়ালাদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে ধ্বংসের হাত থেকে বাংলা চলচ্চিত্রকে রক্ষার পথ দেখিয়েছিলেন সুভাষ দত্ত।
ক’ বছর আগে ‘সুতরাং’ ছবির স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আলোচনায় যোগ স্মৃতিকাতর কবরী বলেছিলেন, “আমি তখন তেরো কি চোদ্দো বছরের কিশোরী। আমাকে এক প্রকার জোর করেই চলচ্চিত্রে নিয়ে আসলেন সুভাষদা। আমার প্রথম ছবি এটি। এটি সুভাষদারও প্রথম। দু’জনই সুপারহিট হলাম। চলচ্চিত্রে আমার সফল যাত্রা শুরু হল।”
তিনি আরও বলেন, “সুভাষদা তুমি আজ নেই, কিন্তু তোমার হাতে গড়া কবরী এখনও আছে। তুমি অনেক তারকাকে আমার মতোই তৈরি করেছ। কিন্তু নিজে রয়ে গেছ নিভৃতে।”
সেই কবরীও বিদায় নিলেন।
কবরী কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এক পর্যায়ে অবস্থার অবনতি হলে, তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় মহাখালি শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে। দু’ দিন আগে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সেখানেই শুক্রবার মধ্যরাতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে কবরীর বয়স হয়েছিল ৭০।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-সহ বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপি, চলচ্চিত্রনির্মাতা এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের তরফে কবরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।
আরও পড়ুন: বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তির বিদায়, বনানী কবরস্থানে সমাহিত কবরী
বাংলাদেশ
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তির বিদায়, বনানী কবরস্থানে সমাহিত কবরী
অভিনেত্রী ছাড়াও তিনি ছিলেন একাধারে সাবেক সংসদ সদস্য, চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক এবং সমাজসেবক।


ঋদি হক: ঢাকা
চলে গেলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরী। শুক্রবার মধ্যরাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই অভিনেত্রী। অভিনেত্রী ছাড়াও তিনি ছিলেন একাধারে সাবেক সংসদ সদস্য, চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক এবং সমাজসেবক। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। শনিবার দুপুরে ঢাকা বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। চোখের জলে এই অনুকরণীয় অভিনেত্রীকে বিদায় জানান সবাই।
৫ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হন কবরী। তার পর কয়েকটি হাসপাতাল বদল করে অবশেষে মহাখালি শেখ রাসেল গ্যাষ্ট্রোলিভার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দু’ দিন আগে তাঁকে নেওয়া হয় নিবিড় পরিচর্যায়। শুক্রবার সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে গেলেন পরপারে। সেই সঙ্গে পর্দা নামল এক কিংবদন্তি অভিনেত্রীর জীবনে।। তাঁর মৃত্যুতে চলচ্চিত্র জগতে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন অনেক শিল্পী।
তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরিণ শারমিন চৌধুরী, বিদেশমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউর হক, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী-সহ বহু মন্ত্রী-এমপি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতের বহু ব্যক্তিত্ব এবং সংগঠন গভীর শোক জানিয়ে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেছেন।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর মেয়ে কবরী। তাঁর আসল নাম মিনা পাল। পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং মা শ্রীমতী লাবণ্যপ্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভাব। ১৯৬৪-তে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং’ ছবিতে জরিনার চরিত্রে অভিনয় করেন মিনা। ‘সুতরাং’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় মিনার। আর সে দিন থেকেই মিনা হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় কবরী।

কবরীর আবির্ভাব ও ‘সুতরাং’-এর কথা
সুভাষ দত্ত যে সব কাজ করতেন, তা অঙ্ক কষে করতেন। কোনো রকম ভুলচুক হলে চলবে না। দশ বার ভেবে সিদ্ধান্ত নিতেন। বাংলার মাটির প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব দরদ। সুভাষবাবু ছিলেন বহু গুণের অধিকারী। একাধারে লেখক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং অভিনেতা। যা করতেন তার নিখুঁত সমাপ্তি টানা পর্যন্ত শান্তি পেতেন না।
বাংলার দিগন্ত প্রসারিত সবুজ ফসলের মাঠ পেরিয়ে গ্রাম। খেতের আল দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ত্যাগী পুরুষ। পরনে কালো রঙের আলখাল্লা, হাত তিনের লম্বা বাঁশের লাঠি তাঁর সঙ্গী। সাধনা-শেষে এক কালো পুরুষ ফসলের মাঠ পেরিয়ে আসছেন। তিনি বহু জায়গা ঘুরেছেন। কিন্তু বাংলার যে অপরূপ রূপ তা কোথায় দেখেননি।
এমন এক ছবির জন্য চাই সেই রকমের এক মিষ্টি মেয়ে, যে নাকি তার ভুবনজয়ী হাসি দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করে নেবে। অবশেষে সেই ভূবনমোহিনী হাসির মেয়ে পেলেন সুভাষবাবু। সন্ধান দিলেন সুরকার সত্য সাহা। বাড়ি চট্টগ্রাম। ১৯৬৪ সালে ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। বছর চোদ্দো বয়সের মেয়েটিকে করা হল সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির নায়িকা। কাহিনির লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার নাম পালটে রাখলেন কবরী। বাংলা চলচ্চিত্র পেল তার এক কিংবদন্তিকে। এর পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
তৎকালীন সময়ে বাংলার রঙ্গালয়ে বিনিযোগ ছিল নামমাত্র। তার ওপরে পাকিস্তানি শাসন। বাংলাকে দাবিয়ে রাখার কুৎসিত মনোবৃত্তি। অবশেষে সুভাষবাবুর ‘সুতরাং’ ছায়াছবির প্রযোজনার দায়িত্ব নেন চট্টগ্রামের তৎকালীন ব্যবসায়ী চিত্ত চৌধুরী। পরবর্তীতে চিত্তবাবুর সঙ্গে বিাবহ বন্ধনে আবদ্ধ হন কবরী।
‘সুতরাং’ ছবিটি মুক্তির পর চার দিকে হইচই পড়ে যায়। ছবিটি দারুণ ব্যবসা করেছিল। পরবর্তীতে কম্বোডিয়ায় একটি চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয় ‘সুতরাং’। তৎকালীন শাহবাগ হোটেলে সংবর্ধনা দেওয়া হয় ছবির পুরো টিমকে।

দর্শকের মনোমন্দিরে স্থান হল কবরীর
ষাটের দশকে বাংলার রঙ্গমঞ্চের পর্দায় আবির্ভাব ঘটে মিষ্টি মেয়ে কবরীর। প্রথম দর্শনেই দর্শকের মনোমন্দিরে স্থান করে নিলেন তিনি। আখড়ায় বাউল-বৈরাগীর একতারার সুর শুনে মন্ত্রমগ্ধের মতো ছুটে যাওয়ার মতোই করবী অভিনীত ছায়াছবির দর্শক বাড়তে থাকে। করবী মানেই ভালো ছবি। মানের ছবি। দর্শকের মনের খোরাক মেটাতে পরিচালকেরা কবরীকে দিয়ে অভিনয় করাতে প্রতিযোগিতায় নামতেন। প্রযোজক চিত্ত চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের পর তাঁদের প্রথম ছেলে ‘বাবুনি’র জন্মের পর কবরী সুযোগ পান জহির রায়হানের উর্দু ছবি ‘বাহানা’য়।
শহিদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ চলচ্চিত্রটি বানিযেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। ‘সারেং বৌ’র কালজয়ী দৃশ্য চরে মিঠাপানি না পেয়ে স্তনদুগ্ধ দিয়ে স্বামী কদমের প্রাণ বাঁচায় নবিতুন। চেতনা ফিরে পেয়ে হাহাকার করে ওঠে কদম! ‘আমারে পর কইরা দিলি বউ?’ কারণ প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, তাদের মধ্যে আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু সব প্রতিকূলতাকে জয় করা সাহসী নবিতুন বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জান বাঁচানো ফরজ।’ নবিতুন ভেঙে দেয় প্রচলিত ঘুণেধরা সংস্কারের বেড়াজাল। এটা কবরীকে দিয়েই সম্ভব।
ঋত্বিক ঘটক কবরীকে নিয়ে বানালেন, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। বাংলার আরেক সমাজসংস্কারক অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৩ সালে তৈরি ঋত্বিকের ছবিটি। কবরী এই ছবিতে রাজার ঝি চরিত্রে স্মরণীয় অভিনয় করেছেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলামের কালজয়ী ছবি ‘দেবদাস’। পার্বতী তথা পারু চরিত্রটি মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটে, বার বার ভেসে ওঠে কবরীর মুখাবয়ব। এমন বহু সংখ্যক কালজয়ী চলচিত্রে অভিনয় করেছেন কবরী।

প্রায় অর্ধ শতকের অভিনয়জীবন
কবরী অভিনীত কত ছবির কথা বলব? ১৯৭৫ সালে নায়ক ফারুকের সঙ্গে ‘সুজন সখী’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর কবরী জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে যান। কবরী অভিনীত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সুতরাং’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়না মতি’, ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’, ‘পরিচয়’, ‘অধিকার’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সোনালী আকাশ’, ‘দীপ নেভে নাই’ ‘বাহানা’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরি’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’ ইত্যাদি।
এই ‘ক খ গ ঘ ঙ’ ছবির শুটিং’এ চুয়াডাঙায় গিয়েছিলেন কবরী। চুয়াডাঙায় তিনি যে বাড়িতে ছিলেন সেই বাড়িটি যে সড়কে তার নাম এখন কবরী রোড। তখন রাজ্জাক-কবরী জুটির ছবির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। ২০০৬ সালে কবরীর পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘আয়না’ মুক্তি পায়। ইদানীং তিনি দ্বিতীয় সিনেমা ‘এই তুমি সেই তুমি’ নির্মাণ করছিলেন।
চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় জীবনের ব্যাপ্তি ১৯৬৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে তিনি প্রায় সোয়া শো ছবিতে অভিনয় করেছেন। বহু বার পুরস্কৃত হয়েছেন। বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন ছ’ বার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন দু’ বার।
১৯৭৮ সালে চিত্ত চৌধুরীর সঙ্গে কবরীর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। সেই বছরেই তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দীন সারোয়ারকে। ২০০৮ সালে এই বিয়েরও বিচ্ছেদ ঘটে যায়। ওই বছরই নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ওই দায়িত্ব পালন করেন।
অভিনয়জগতে যাঁরা কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন, তাঁরা সকলেই ইতিহাসের অঙ্গ হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে বাংলার আরেক কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের কথাও বলা যায়। তাঁরও মৃত্যু হয়েছিল হাসপাতালে। সেই তারিখটা ছিল ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি। আর বাংলার আরেক কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরীর (সারাবেগম কবরী) মৃত্যুও ১৭ তারিখ। তবে ২০২১। সাত বছর পর। দু’ জনই ছিলেন সাড়াজাগানো অভিনেত্রী। ইহজগত থেকে এঁদের বিদায় যে শূন্যতার সৃষ্টি করে তা কখনও ভরাট হয় না।
বাংলাদেশ
Mujibnagar Day: ঠিক ৫০ বছর আগের ১৭ এপ্রিল যিনি গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন সেই মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রমের স্মৃতিচারণ
মাহবুব উদ্দিন বলেন, “একাত্তরে সাধারণ মানুষ, আদিবাসী-সহ সকলে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আর সেই যুদ্ধ ছিল বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ।”


ঋদি হক: ঢাকা
আজ ১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন মেহেরপুর বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার গঠিত হয়। সে দিন কলকাতা থেকে গাড়ি-বহর নিয়ে এসে বৈদ্যনাথতলায় শপথ নেন অস্থায়ী সরকারের সদস্যরা। আর এই শপথগ্রহণের মধ্য দিয়েই বিশ্ব জানতে পারে বাংলাদেশের নাম।
করোনা মহামারিতেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে পালন করা হবে আজকের দিনটি। সকালে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হোসেন।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক পুলিশ অফিসার। ২৩-২৪ বছরের টগবগে যুবক। তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমার পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও)। অস্থায়ী সরকারকে প্রথম গার্ড অব অনার দেন তিনিই।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি। সে দিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মাথার ওপরে পত পত করে উড়ছে লালসবুজে খচিত বাংলাদেশের পতাকা। সেই পতাকায় সেই টগবগে যুবক দেখতে পান বঙ্গবন্ধুর মুখ। এর পর গার্ড অব অনার দেন তিনি। গর্জে ওঠে তাঁর কন্ঠ। খালি গলার কমান্ডে কেঁপে ওঠে বৈদ্যনাথতলার আকাশ-বাতাস। তিনি, মাহবুব উদ্দিন আহমেদ।
এক ঐশ্বরিক শক্তি ভর করে তাঁর মাঝে। বুটজুতোয় মাটি কাঁপিয়ে চলে গার্ড অব অনার। হাজারো মানুষের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে বৈদ্যনাথতলার চতুর্দিক প্রকম্পিত। তার মধ্যেই মাহবুব উদ্দিনের কমান্ড আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। বিনা মাইকে এমনই কমান্ডের শক্তি কোথা থেকে এল তা আজও তাঁর অজানা। আসলে কারণ তখন তাঁর মনে, তাঁর প্রাণে একটাই ছবি – বঙ্গবন্ধুর মুখ।

স্মৃতির পথ বেয়ে চলে গেলেন পঞ্চাশ বছর আগের মেহেরপুরে। এক যুবক পুলিশ অফিসার। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন, কী ভাবে সম্ভব হয়েছিল ‘সে দিনের কমান্ড’? কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন তিনি।
তাঁর গুলশান অফিসে বসে কথা হচ্ছিল।
তার পর? বলুন।
ফের স্মৃতির জানলা খুলে ধরেন প্রায় ৭৪ বছর বয়সি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম। বললেন, “তোমাকে আরও একটি কথা বলা হয়নি। তা হচ্ছে, ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবার পর দিন ১৮ এপ্রিল কলকাতার পার্ক সার্কাসে সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন হাইকমিশন অফিসে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।”
সেটাই ছিল বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। যার উদ্যোগ নিয়েছিলেন হাইকমিশনের অন্যতম কর্মকর্তা হোসেন আলী। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত করেন। বাংলাদেশের সেই পতাকা উত্তোলনকালেও গার্ড অব অনার-এর দায়িত্ব পালন করেন মাহবুব উদ্দিন। বললেন, “জানো, এই দু’টো ঐতিহাসিক ঘটনা আজও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে, সে দিনের ঘটনা।”
১৭ এপ্রিল কলকাতার থিয়েটার রোড থেকে সে দিন গাড়ি-বহর নিয়ে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের সদস্য হিসাবে শপথ নিতে বৈদ্যানাথতলায় এসেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান-সহ অন্যরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন দেশি-বিদেশি বেশ কিছু সাংবাদিকও।
নদিয়ার কৃষ্ণনগর দিয়ে এসে বাংলাদেশ সীমান্ত। সেখান থেকে বর্তমান মুজিবনগরের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। এই ধরো সর্বোচ্চ মাইল দু’য়েক বা তার কম হতে পারে, বললেন মাহবুব উদ্দিন।
মাহবুব উদ্দিন বললেন, “এ বারে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২৬-২৭ মার্চ বাংলাদেশ সফর করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এ সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদী মুজিবনগর-কৃষ্ণনগরের মধ্যে স্বাধীনতা সড়কটির উদ্বোধন করেন। করোনার কারণে সেখানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নতুবা আমি তো অবশ্যই যেতাম।”
স্বাধীনতা সড়কের বাংলাদেশ অংশটি এখন ডাবল লেন করা হয়েছে। নদিয়া ও আশেপাশের মানুষ এখন খুব সহজেই মুজিবনগর আসতে পারবেন এবং জাদুঘর থেকে শুরু করে পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করতে পারবেন।
আচ্ছা, মুজিবনগর সরকার বা বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, আগে থেকে এমন কোনো তথ্য আপনি জানতেন?
মাহবুবউদ্দিনের কথায়, “তোমাকে তো আগেই জানিয়েছি, আমি তখন তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমায় পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও)। ১৭ এপ্রিল সকালবেলায় খবর পেলাম আমাকে বৈদ্যনাথতলায় যেতে হবে। কারণ সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেবে।
“নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পৌঁছুলাম বৈদ্যনাথতলায়। তাতে খুব একটা সময় লাগেনি। মুক্তাঞ্চল বৈদ্যনাথতলা। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম একটি ছোটো আকারের মঞ্চ। তার উপরে কয়েকটি পুরোনো চেয়ার ও একটি ছোটো টেবিল।
“মঞ্চের এক কোনায় একটা সরু বাশ পোঁতা। মঞ্চ ঘিরে স্থানীয় মানুষের ভিড়। মঞ্চের পাশে প্রহরায় ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর ক’ জন সদস্য। একটু দূরে একটা হারমোনিয়ামে চলছিল জাতীয় সংগীতের রিহার্সেল। হারমোনিয়াম থেকে শুরু করে সব কিছুই সংগ্রহ করা। বেলা তখন ১১টা হবে। গাড়িবহর নিয়ে কলকাতা থেকে নেতৃবৃন্দ বৈদ্যনাথতলায় উপস্থিত হলেন।
“কিছুক্ষণের মধ্যে মঞ্চে আসন নিলেন তাঁরা। এর পর ঘোষণা দেওয়া হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী প্রধান সেনাপতি।
“অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন টাঙাইলের জননেতা আব্দুল মান্নান, এমএনএ। পরিচয়পর্বের পর শপথবাক্য পাঠ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এমএনএ।”
এর পর, এর পর কী হলো বলুন?
স্মৃতির অতলে ডুব দিলেন মাহবুব উদ্দিন। তিনি মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল তার মধ্যে একটা উত্তেজনা কাজ করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার, বঙ্গন্ধুর মুখ, গণহত্যা ইত্যাদি তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এ বারে সোজা হয়ে বসলেন বীরযোদ্ধা।
“জানো এর পরই আমার পালা। এটিকে জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণই বলব। একটা জাতির ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার-প্রধানকে আমার নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদান করা হল। আমি তৃপ্ত হলাম।
“জীবনে আর কোনো দিন এমন করে গর্জে ওঠে কমান্ড দেওয়ার সুযোগও পাব কিনা সন্দেহ। যখন গার্ড অব অনার দিচ্ছিলাম, তখন ক্যামেরার অসংখ্য ফ্লাশ জ্বলে উঠছিল। সেই সঙ্গে হাজারো মানুষের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠছিল।
“গার্ড অব অনার বিষয়ে তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। গার্ড অব অনার-এর দায়িত্ব পালনের কথা ছিল তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর। অজ্ঞাত কারণে তিনি সেখানে উপস্থিত হতে পারেননি। এ সময় হন্তদন্ত হয়ে বন্ধু তৌফিক-ই-এলাহী (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা) এসে বলল, ‘ওসমান ভাই তো আসার কথা ছিল। কিন্তু উনি তো এলেন না। এখন কী করি? গার্ড অব অনার কী করে দেওয়া যায় চিন্তা করো’।
“আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম, তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে বহু গার্ড অব অনার দিয়েছি এবং নিয়েছি। সব ঠিক করে নেবো। এর পর আমি তৎক্ষণিক গার্ড অব অনার-এর ব্যবস্থা করি।”
সেটা কী ভাবে সম্ভব হল?
মাহবুব উদ্দিন বলে চলেন, “আমার সঙ্গে তিন-চারজন পুলিশ কনস্টেবল ছিল। আর আশপাশ থেকে কয়েক জন আনসার এনে কয়েক মিনিটের প্রশিক্ষণ দিলাম। তার পর বলাম আমি প্রস্তুত। এর পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। পেছনে প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী। মঞ্চের বাঁ দিকে মাটিতে দাঁড়িয়ে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ। অন্য সবাই মঞ্চের পাশে অপেক্ষা করছেন।
“এ অবস্থায় আমার নেতৃত্বে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার প্রদান করলাম। প্রেজেন্ট আর্মস করে সৈনিকেরা যখন তাদের রাইফেল ঊর্ধ্বমুখী করে দাঁড়াল তখন আমি হাত তুলে তাঁকে স্যালুট দিলাম। তিনি স্যালুট গ্রহণ করলেন।
“আর সঙ্গে সঙ্গে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বেজে উঠল। এর পর মঞ্চের পাশে সরু বাঁশটিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
“বাতাসে পতাকাটা পতপত করে উড়ছে। সেই পতাকায় দেখতে পেলাম বঙ্গবন্ধুর মুখ। পতাকা উত্তোলনের পর মঞ্চে দাঁড়ালেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। জাতীয় সংগীত শেষে কমান্ড দিয়ে সালাম শেষ হল। রাইফেলধারীদের অস্ত্র নেমে এল ঘাড়ে। আমিও হাত নামালাম। কুইক মার্চ করে সামনে এগিয়ে গেলাম দু’ কদম। তার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে সালাম জানিয়ে বললাম, ‘স্যার, আমাদের দল আপনার পরিদর্শনের অপেক্ষায়।’
“তিনি ধীর পদক্ষেপে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গার্ড অব অনার পরিদর্শন করলাম। অবশেষে তিনি আবার মঞ্চে ফিরে গেলেন। আমি সৈনিকদের সামনে দাঁড়িয়ে আবার তাঁকে সালাম জানিয়ে বললাম, ‘আমি এখন সৈনিকদের নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাই।’ তিনি অনুমতি দিলেন।
“এর পর আমি মার্চপাস্ট করে মঞ্চের সামনে থেকে সরে গেলাম। এ সময় উপস্থিত হাজারো মানুষের কণ্ঠ এক সঙ্গে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে বৈদ্যনাথতলার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সে এক অভূতপূর্ব মুর্হূত। অনুধাবন করা যায়। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
“পরবর্তীতে মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। তিনি কয়েক জনকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ঘোষণা দিলেন, আজ থেকে বৈদ্যনাথতলার নাম হবে ‘মুজিবনগর’। আর এ মুজিবনগরই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। এখান থেকেই সরকারের সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
“তাজউদ্দিন আহমদের ঐতিহাসিক ঘোষণায়ই বৈদ্যনাথতলা ‘মুজিবনগর’ নামে স্বীকৃতি পেল। আর এই মুজিবনগর সরকার গঠনের মধ্য দিয়েই গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে স্বাধীন বাংলার অস্তিত্বের কথা।”
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম

১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করেন। এর পর ১৯৬৭ সালে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে সারদা পুলিশ একাডেমিতে যোগদান করেন। তৎকালীন যশোর জেলার অধীনে ঝিনাইদহ ছিল একটি মহকুমা। ১৯৭১ সালে ঝিনাইদহ মহকুমার পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বেই তিনি অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কুষ্টিয়া এবং ঝিনাইদহের জনযুদ্ধে স্থানীয় জনতাকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করেন এবং তাদের সমস্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া ১০ ও ১২ এপ্রিল মান্দারতলায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। এর পর ১৩ এপ্রিল বারোবাজারে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধে অংশ নেন।
২০ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনীর বৈকারী ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালাতে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ব্যারাকপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হন। আহত এক যোদ্ধা রণাঙ্গনের পরিবর্তে হাসপাতালে, কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি যে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার এক লড়াকু সৈনিক। হাসপাতালের বিছানা তাঁকে মানায় না। বিছানায় ছটপট করতে থাকেন। অসামান্য দৃঢ় মনোবলের এই যোদ্ধা কখন ফিরে যাবেন রণাঙ্গনে! যেখানে মায়ের আঁচল তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি, সেখানে হাসপাতালের বিছানায় আটকা পড়ে মাঝে মাঝেই খেপে উঠছিলেন মাহবুব উদ্দিন।
এর পর ২৬ দিনের মাথায় অর্থাৎ ১৬ অক্টোবর ফের রণাঙ্গনে ফিরে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে।
উপসংহারে যে কথা বললেন
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উক্তি টেনে বলেন, “বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার একটা বীজ পুঁতে রেখে গেলাম। এই বীজ যে দিন উৎপাটন করা হবে, সে দিন বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে’। আমাদের সেই স্বপ্নের পথে এগোতে হবে। একাত্তরে সাধারণ মানুষ, আদিবাসী-সহ সকলে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আর সেই যুদ্ধ ছিল বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ।”
কথা শেষ
এ বার বিদায়ের পালা। উঠে দাঁড়ালাম। তিনিও আশীর্বাদ করলেন, বললেন, “ভালো থেকো আর দেশের জন্য কাজ করো”। তাঁর উপদেশ মাথায় নিয়ে মনে মনে তাঁকে গার্ড অব অনার দিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বললাম, “বিদায় বীর যোদ্ধা এবং ইতিহাসের সাক্ষী মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম”।
-
রাজ্য21 hours ago
Bengal Polls Live: পৌনে ৬টা পর্যন্ত ভোট পড়ল ৭৮.৩৬ শতাংশ
-
শিক্ষা ও কেরিয়ার1 day ago
ICSE And ISC Exams: দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা পিছিয়ে দিল আইসিএসই বোর্ড
-
ক্রিকেট1 day ago
IPL 2021: দীপক চাহরের বিধ্বংসী বোলিং, চেন্নাইয়ের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ল পঞ্জাব
-
মুর্শিদাবাদ1 day ago
Coronavirus Second Wave: কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন রাজ্যের আরও এক প্রার্থী