কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক প্রয়াত

0

‘আগুনপাখি’র বিদায়। প্রয়াত হলেন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটোগল্পকার, প্রবন্ধকার ও ঔপন্যাসিক হাসান আজিজুল হক। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। সোমবার ভারতীয় সময় রাত ন’টা নাগাদ তাঁর রাজশাহীর বাসভবন ‘উজান’-এই তিনি মারা যান।

বেশ কিছু দিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে কয়েক দিনের জন্য ঢাকার ন্যাশনাল হার্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি করাতে হয়। তবে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু আর তাঁকে ধরে রাখা গেল না। রেখে গেলেন স্ত্রী এবং তিন কন্যা ও এক পুত্রকে। হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যজগত গভীর ভাবে শোকাহত।

সংক্ষিপ্ত জীবনী    

‘যে বাইরে থেকে ভিতরে আসে, যে নতুন করে জন্ম নেয়, একটি নতুন দেশ যার অধিগ্রহণ করে, জীবন-মাকড়সার জটিল জালে যে আটকে যায় আমার অবস্থা যেন তাই। এখন আমি ভিতরের লোক” – নিজের সম্পর্কে বলেছেন হাসান আজিজুল হক। মাত্র ১৬ বছর বয়সে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। কিশোর হাসান বর্ধমানের যবগ্রাম ছেড়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন পূর্ব বাংলার দৌলতপুরে।

হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার জবগ্রামে। ১৯৫৪ সালে নিজেদের গ্রামের মহারানী কাশীশ্বরী হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর জীবনযাপন ভিতরে ও বাইরে পালটে যায়। চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধুনা বাংলাদেশের খুলনার দৌলতপুরে।

১৯৫৬ সালে দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর দর্শনশাস্ত্রে অনার্স নিয়ে পড়ার জন্য হাসান আজিজুল রাজশাহী সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজে পড়তে পড়তে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং পাক সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৬০ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

এর পর হাসান আজিজুল কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ ও দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেন। এর পর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই টানা ৩১ বছর অধ্যাপনা করে ২০০৪ সালে অবসর নেন। ২০০৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের জন্য মনোনীত হন। ২০১৪ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।

সাহিত্যসৃষ্টি

হাসান আজিজুল হকের লেখালেখি শুরু কিশোর বয়সেই। ম্যাট্রিক পাশের পরই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন, যা আজ পর্যন্ত অপ্রকাশিত। ১৯৫৬ সালে ‘মুকুল’ পত্রিকায় তাঁর ‘মাটি ও পাহাড়’ নামে একটি গল্প প্রকাশিত হয়। আরও কিছু লেখালেখির পর ১৯৬০ সালে সিকান্দার আবু জফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় ‘শকুন’ গল্পের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। এর পর থেকেই তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ লেখালেখি করতে থাকেন।  

হাসান আজিজুল হক প্রথম উপন্যাস লেখেন ২০০৬ সালে। ‘আগুনপাখি’ নামক সেই উপন্যাসের পটভূমি রাঢ়বঙ্গ। তবে এর বহু আগে ১৯৬০-এই তিনি ‘বৃত্তায়ন’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, তবে তিনি নিজেই সেই লেখাকে উপন্যাস বলতে অস্বীকার করেন।

হাসান আজিজুল হক তাঁর ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে এক বড়ো কালপর্বকে ধরেছেন। এই উপন্যাসে এসেছে মহামারি, অনাহার, সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং দেশভাগ। এই উপন্যাসের জন্যই ২০০৮ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান।

তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে – গল্পগ্রন্থ: সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন থেকে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, আমরা অপেক্ষা করছি, রোদে যাবো, মা মেয়ের সংসার, রাঢ়বঙ্গের গল্প, হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠ গল্প ইত্যাদি। শিশুসাহিত্য: ফুটবল থেকে সাবধান, লাল ঘোড়া আমি। উপন্যাস: আগুনপাখি, সাবিত্রী উপখ্যান, শামুক। উপন্যাসিকা: বৃত্তায়ন। নাটক: চন্দর কোথায়। আত্মজীবনীমূলক লেখা: ফিরে যাই, ফিরে আসি (১ম অংশ), উঁকি দিয়ে দিগন্ত (২য় অংশ), এই পুরাতন আখরগুলি (৩য় অংশ), লন্ডনের ডায়েরি ইত্যাদি। প্রবন্ধ: কথাসাহিত্যের কথকতা, চালচিত্রের খুঁটিনাটি, সক্রেটিস, একাত্তর: করতলে ছিন্নমাথা, রবীন্দ্রনাথ ও ভাষাভাবনা, অপ্রকাশে ভার, অতলের আধি ইত্যাদি।   

বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন হাসান আজিজুল হক, যার মধ্যে আনন্দ পুরস্কার ছাড়াও রয়েছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলাদেশ সরকারের তরফে স্বাধীনতা পুরস্কার ইত্যাদি। ২০১২ সালে অসম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি লিট সম্মাননা প্রদান করে।

আরও পড়তে পারেন

বন্যা পরবর্তী পুনর্গঠনে দুর্নীতির অভিযোগ, ক্যাগকে অডিটের নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট

নাড়া পোড়ানো থেকে দূষণ হয় মাত্র ১০ শতাংশ, সুপ্রিম কোর্টে জানাল কেন্দ্র

দূষণ ঠেকাতে কড়া লকডাউন ঘোষণা করতে প্রস্তুত, সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে জানাল দিল্লি সরকার

হিন্দু ভোট টানতে এ বার গোরুর জন্য অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা চালু করল যোগী আদিত্যনাথ সরকার

বিজ্ঞাপন