খবর অনলাইন ডেস্ক: ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী শাফিন আহমেদের প্রয়াণে দুই বাংলার সংগীতজগত শোকে মুহ্যমান। গত বৃহস্পতিবার ২৫ জুলাই সকাল সাড়ে ৬টা (ভারতীয় সময়) নাগাদ আমেরিকার ভার্জিনিয়া সেন্টার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের রক ব্যান্ড ‘মাইল্স’-এর প্রধান গায়ক, মুখ্য সংগীত রচয়িতা এবং বেইসিস্ট (বাস গিটার বাদক) শাফিন আহমেদ। কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগমের কনিষ্ঠ পুত্র শাফিনের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
ভার্জিনিয়া সেন্টার হাসপাতালে শাফিন আহমেদের চিকিৎসা চলছিল। তিনি তৃতীয়বার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হৃদপিণ্ডে স্টেন্ট বসানো হয়েছিল। শাফিন আহমেদের কিডনির চিকিৎসাও চলছিল। চলছিল ডায়ালিসিস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে আসতে থাকে। ফলে শরীরের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোও কাজ করছিল না। তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
সোমবার বিকেলে শাফিনের মরদেহ ঢাকায় আসার কথা। রবিবার বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হবে বলে ‘প্রথম আলো’কে জানিয়েছেন তাঁর বড়ো ভাই ও ‘মাইল্স’ ব্যান্ডের সদস্য হামিন আহমেদ।
‘মাইল্স’-এর হয়ে শাফিনের গান ‘পাহাড়ি মেয়ে’, ‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি’, ‘ধিকি ধিকি জ্বলে আগুন’, ‘ফিরিয়ে দাও, আমার-ই প্রেম তুমি ফিরিয়ে দাও’, ‘নীলা’, ‘নিঃস্ব’ ইত্যাদি ছাত্রসমাজের কাছে প্রায় জাতীয় সংগীতের মতো। দুই বাংলার কনসার্টে এই গানগুলো বারবার শোনা গিয়েছে।
এপার বাংলার প্রতিক্রিয়া
শাফিনের প্রয়াণসংবাদে ওপার বাংলার মতো এপার বাংলার সংগীতজগতও শোকাচ্ছন্ন। ক্যাকটাস ব্যান্ডের কর্ণধার সিধু ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’কে বলেন, “যত বয়স বাড়তে থাকে, সংগীতশিল্পীদের চলে যাওয়ার খবর আমাদের নশ্বরতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। একজন শিল্পীর কাছে সবচেয়ে বড়ো বিষয় হল, গুঢ় অর্থপূর্ণ এবং প্রভাব বিস্তারে সক্ষম কিছু গান সৃষ্টি করা। কারণ শেষ পর্যন্ত ওই সব চিরন্তন গানের মধ্য দিয়েই তো শিল্পী বেঁচে থাকেন।” ‘মাইল্স’-এর সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করলেন সিধু। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সংস্কৃতি’ এবং ‘এপার ওপার’ কনসার্টে বেশ কয়েক বার গ্রিন রুম শেয়ার করেছে ‘মাইল্স’ এবং সিধুর ‘ক্যাকটস’।
স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র অন্যতম স্রষ্টা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র গৌরব। স্কুলছাত্র থাকার সময়েই শাফিনের গানের সঙ্গে পরিচয় গৌরবের। ‘মাইল্স’ আর ‘লক্ষ্মীছাড়া’ কলকাতায় একসঙ্গে দুটো কনসার্ট করেছে। গৌরবের কথায়, “একবার ২০০৩ সালে স্বভূমিতে কেবিএল বাংলা রক শোয়ে। আমি তখন পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিচ্ছি। আর-এক বার নজরুল মঞ্চে ২০০৭-২০০৮ সালে।” শোয়ের একেবারে শেষ দিকে ‘মাইল্স’ আর ‘লক্ষ্মীছাড়া’ একসঙ্গে গেয়েছিল গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘পৃথিবীটা নাকি ছোটো হতে হতে’।
‘মাইল্স’-এ ছিলেন ৪২টা বছর
সংগীতজগতের কিংবদন্তি দম্পতির কনিষ্ঠ সন্তান শাফিন আহমেদ। তাঁর মা প্রথিতযশা নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম আর বাবা প্রসিদ্ধ সুরকার, সংগীত পরিচালক ও শিল্পী কমল দাশগুপ্ত। কলকাতায় ১৯৬১-তে জন্ম শাফিনের। ষাটের দশকের শেষ দিকে তাঁদের পরিবার ঢাকায় চলে আসে। শাফিন নজরুলসংগীত দিয়ে তাঁর সংগীতচর্চা শুরু করেন মাত্র ৯ বছর বয়সে।
শাফিন আহমেদ ‘মাইল্স’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘ ৪২ বছর। ১৯৭৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ে মাঝেমাঝে ‘মাইল্স’ থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন, আবার ফিরে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত ২০২১-এ ‘মাইল্স’-এর সঙ্গে পাকাপাকিভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরই মাঝে ২০১০-এ তিনি ‘মাইল্স’ থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজস্ব ব্যান্ড গড়েন, নাম ‘রিদম অফ লাইফ’। কিন্তু সেই ব্যান্ডও গুটিয়ে দিয়ে ২০১৩-এর শেষ দিকে ‘মাইল্স’-এ ফিরে এসেছিলেন শাফিন আহমেদ। ২০২১-এর পর থেকে ‘ভয়েস অব মাইলস’ নামে ব্যান্ড গঠন করে কনসার্ট করছিলেন শাফিন। তবে তাতে খুব একটা সফল না হলেও একক সংগীত পরিবেশনে তাঁর সুখ্যাতি বহাল ছিল।
শুরুর দিকে ‘মাইল্স’-এ শুধু ইংরেজি গান করতেন শাফিন। ১৯৯১ সালে ‘প্রতিশ্রুতি’ অ্যালবাম প্রকশের মধ্য দিয়ে বাংলা গানে তাঁর পথচলা শুরু। এই ব্যান্ডের কার্যত প্রায় সব গান তাঁর কণ্ঠের সৃষ্টি।
আরও পড়ুন
বিদেশে পড়তে গিয়ে গত ৫ বছরে ৬৩৩ জন ভারতীয় পড়ুয়ার মৃত্যু, সবচেয়ে বেশি কানাডায়