দিল্লি থেকে হরপ্রসাদ সেন
বসন্তের ছোঁয়া আগেই লেগেছে দিল্লিতে। পার্কগুলো ভরে উঠেছে নানা রকম বাহারি ফুলে। মানভূমের পলাশ না হলেও, শিমূল একাই রাঙিয়ে তুলেছে রাস্তার দু’ দিক। এক দিকে প্রকৃতির এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আর অন্য দিকে দিল্লির আবহাওয়া –- এই দুইয়ের প্রভাবে দিল্লিবাসী, বিশেষ করে রাজধানী শহরের বাঙালিকুল রীতিমতো উজ্জীবিত। প্রকৃতি আর বইয়ের সঙ্গে সব বাঙালিরই প্রেম। যতই আমরা ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত থাকি না কেন, বই ছাড়া আমাদের এক মুহূর্তও চলে না।
প্রতি বছরের মতো এ বারেও সেই সুযোগ এনে দিয়েছে দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন। নিউদিল্লির কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে চলছে পঞ্চদশ বইমেলা ও বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব। শুরু হয়েছে ১৫ মার্চ, উদ্বোধন করেছেন সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। চলবে ২০ মার্চ রবিবার পর্যন্ত। এই বইমেলায় হাজির হয়েছেন কলকাতার প্রথম সারির ৩৫টি প্রকাশন সংস্থা। এ বারের বইমেলা পেয়েছে আন্তর্জাতিক ছোঁয়া। বাংলাদেশ থেকে এসেছে একটি প্রকাশন সংস্থা। এসেছে বহু সাংস্কৃতিক সংস্থাও। দিল্লিতে বাংলা বই পাওয়া যায় না, তা নয়। কিন্তু এক সাথে এক জায়গায় সব রকমের বাংলা বই দেখতে পাওয়া বই-প্রেমিক বাঙালির কাছে একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।
গত ১৫ বছর ধরে এই মেলা যাঁরা আয়োজন করে আসছেন, তাঁদের অন্যতম প্রণব চক্রবর্তী মহাশয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এক সময় দিল্লিতে বাঙালি আমলাদের খুব দাপট ছিল। এখন তা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। দিল্লির বর্তমান প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়েদের বাংলা ভাষার প্রতি অনীহার কথা বলছিলেন প্রণববাবু। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন, বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই ইংরিজি বা হিন্দিতে কথা বলতে অভ্যস্ত। বই পড়া তো দূরের কথা, ভালো করে মাতৃভাষাটাই বলতে পারে না। মাতৃভাষাকে তারা দূরে ঠেলে রেখেছে। তিন পুরুষ দিল্লির বাসিন্দা প্রণববাবুর আক্ষেপ, দিল্লির বাঙালিরা শীঘ্রই তাদের অনেক কিছু নিজস্বতা হারিয়ে ফেলবে। এই অবক্ষয় ঠেকাতে অসাধ্য সাধনের ব্রতয় নেমেছে দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন।
প্রকাশন সংস্থার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, বইমেলায় বিক্রিবাটা খুব একটা উৎসাহজনক নয়। যদিও আনন্দ পাবলিশার্স এবং পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড তা মানতে রাজি নয়। বইমেলা সংগঠনের চেয়ারম্যান দেবাশিস ভৌমিক আশায় আছেন শনি ও রবিবার বইমেলা আরও জমবে, বিক্রিবাটাও বাড়বে। এমনটি আশা করেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তপন সেনগুপ্তও। তাঁর আক্ষেপ, “আরও অনেক প্রকাশক আসতে চেয়েছিলেন। জায়গার অভাবে অনেককে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে।”
বাঙালির আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকবে না, তা কি হয় ? দিল্লির এই আসরের আসল নামটি তো ‘পঞ্চদশ দিল্লি বইমেলা ও বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব ২০১৬’। তাই রোজই মেলার মঞ্চে আয়োজিত হচ্ছে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কীর্তন, বাউল, গম্ভীরা – বাংলার লোকসংস্কৃতির নানা নমুনা পরিবেশিত হচ্ছে বইমেলার ছ’ দিনই। থাকছে দিল্লির কলাকুশলীদের পরিবেশনায় ‘চাঁদ বণিকের পালা’, বহরমপুরের কলাক্ষেত্রের উপস্থাপনা ছৌ নাচে ‘তাসের দেশ’। বসছে কবিতাপাঠের আসর, শ্রুতিনাটকের আসর। কলকাতার নামী-দামি শিল্পীদের পাশাপাশি থাকছেন বডোদরা ও চেন্নাইয়ের বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের শিল্পীরাও।
আর রসনার জন্য বাঙালির সুখ্যাতি তো বিশ্ববন্দিত। খাওয়া ছাড়া বাঙালির কোনও অনুষ্ঠানই সম্পূর্ণ হয় না। তাই বইমেলায় চপ-তেলেভাজা থেকে বাঙালির জিভের তৃপ্তির জন্য হরেক আয়োজন।
এ ধরনের একটা জমজমাট পূর্ণাঙ্গ মেলা উপহার দেওয়ার জন্য বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতেই হয়।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।