খবর অনলাইন : “সব মনোযোগ লাতুর আর মরাঠাওয়াড়ার দিকে। আমাদের এই সাতারা তো খরা-খবরের শিরোনামে নেই, তাই এ দিকে খুব একটা নজর নেই কারও। জলের অভাবে মানুষ, পশু, শস্য মরে যাচ্ছে। কারও হুঁশ নেই। না সরকারের, না কোনও এনজিও-র” – আক্ষেপ করছিলেন সাতারার চাষি লক্ষ্মণ নালে।
সাত জনের পরিবার নালের। বাবা-মা, স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে। সাতারা শহর থেকে ৭০ কিমি দূরে ফলতন তালুকের গ্রামে থাকেন। ৫০ বছরের চাষি পরিবার। এ বার লাগিয়েছিলেন বেদানা গাছ। খর রোদে সব চারা একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে। ঠিকঠাক ফলন হলে এই চাষ থেকে বছরে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা আয় হয়। এ বছর চাষের জন্য যে টাকা ঢালা হয়েছিল, তার সবটা গিয়েছে। চাষ থেকে সংসারে কোনও আয় নেই। তাই লক্ষ্মণের বাবা কাছাকাছি একটা কনস্ট্রাকশনের জায়গায় কাজ করছেন। কিন্তু তাঁর দৈনিক মজুরি এত কম যে গোটা পরিবারের খাওয়াখরচ তো দূরের কথা, অসুস্থ মায়ের ওষুধের খরচও ওঠে না।
নালে বলছিলেন, “আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আমি আর্টস গ্র্যাজুয়েট। তেমন কোনও চাকরি না পেয়ে ড্রাইভিংয়ের কাজ করছিলাম। কিন্তু বাবা কনস্ট্রাকশন লেবারের কাজ নিল বলে আমাকে ড্রাইভিংয়ের কাজটা ছেড়ে দিতে হল। কারণ চাষটা তো দেখতে হবে। কিন্তু অবস্থা খুব খারাপ। প্রকৃতির রোষে পড়েছে গোটা গ্রাম। এখন বুঝতে পারছি কেন চাষিরা আত্মঘাতী হয়।”
মহারাষ্ট্রের সাতারায় বছরে চার মাস বৃষ্টির মরশুম। গড়ে বৃষ্টি হয় ৯০০ মিমি। মরাঠাওয়াড়ার কয়েকটি জেলা, বিশেষ করে পার্ভনি, নান্দেদ ইত্যাদি অঞ্চল থেকেও কম। ফলতন তালুকে জলের জন্য একমাত্র ভরসা বৃষ্টি। অন্য কোনও জলের উৎস কাছেপিঠে নেই। বর্ষার জল ধরে রাখা হয় কুয়োয়। সারা বছর এই কুয়ো থেকে জল নিয়ে দিন চলে। এর আগে ২০০৪-এও খরা দেখেছে সাতারার এই অঞ্চল। কিন্তু এ বারের খরা যেন অনেক বেশি মারাত্মক। আট মাস এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। মাটি একেবারে ফুটিফাটা। জলের অভাবে শস্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে, গবাদি পশু মরতে বসেছে। এর ওপর রয়েছে চিনি কারখানা। ফলতন তালুকে চারটে বড়ো সুগার ফ্যাক্টরি আছে। এতে প্রচুর জল লাগে। ক্যানালের সব জল ওই কারখানাগুলোতেই চলে যায়।
“সরকারের নজর, মেডিয়ার নজর, এনজিওদের নজর শুধু মরাঠাওয়াড়া-লাতুর-বিদর্ভের দিকে। লাতুরে রেলস্টেশন আছে। মালগাড়ি জল নিয়ে নিয়মিত যাচ্ছে লাতুরে। আর আমাদের গ্রামের সঙ্গে তো কোনও রেলসংযোগ নেই। তাই জল পাঠানোর কোনও উদ্যোগও নেই। এমন দিন যায় যখন টানা আট দিন জল ছাড়া চালাতে হয়” –- লক্ষ্মণের গলায় অভিমান ঝরে পড়ে।
কিন্তু খাওয়ার জল ?
তার জন্য লক্ষ্মণের গ্রামকে জল কিনতে হয়। গ্রামের সাড়ে চার হাজার মানুষের জন্য এক ট্যাংকার জল, দেড় হাজার টাকা দিয়ে। সেই জলে গ্রামের কুয়ো ভর্তি করা হয়। তার থেকে জল টেনে গ্রামবাসীরা জলের জরুরি প্রয়োজন মেটান। কিন্তু এ ভাবে কত দিন ? পকেট যে গড়ের মাঠ হয়ে যাচ্ছে।
গ্রামবাসীদের অনেকে মনে করেন, অসমাপ্ত দোহমবলকোয়াড়ি ড্যামের কাজ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শেষ করলে এ অঞ্চলে জল সমস্যা অনেকটাই মিটবে। পূর্ব ফলতনে যে সব ক্যানাল রয়েছে সেগুলো এই ড্যামের সঙ্গে যুক্ত। তা ছাড়াও গ্রামবাসীরা মনে করেন, আগেকার সরকারের মতো বর্তমান সরকারও যদি পশুখাদ্যের শিবির বসাত, তা হলেও গবাদিপশুগুলো অন্তত বাঁচত। এক সময় গ্রামে বসত ‘চরা চওয়ানি’। গ্রামের মানুষ তাঁদের গবাদিপশু এই শিবিরে রেখে আসতেন। সরকার তাদের খাওয়াত, পানীয় জল দিত। পুরোটাই বিনা পয়সায়। গ্রামবাসীদের পকেট থেকে এক পয়সাও যেত না। গরিব চাষিরা খুবই উপকৃত হতেন। বছর দুয়েক হল, সেই শিবির আর বসে না।
“আসলে আমরা তো বড়ো ভোটব্যাঙ্ক নই। তাই আমাদের দুর্দশা কারও নজরে পড়ে না” –- হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে বসে থাকেন লক্ষ্মণ ও তাঁর গ্রাম।
সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।