তাঁর আমলেই স্লোগান উঠেছিল, কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। সেই লক্ষ্যেই সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ করেছিল তাঁর সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জল গড়ায় অনেকদূর। ভোটের ফলে শোচনীয় পরাজয় হয় বামেদের। অবসান হয় বামফ্রন্ট শাসনের। তার পর থেকে নিজেকে কার্যত গৃহবন্দি করে ফেলেছিলেন ৩৪ বছরের বামশাসনের শেষ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অনেকের মতে, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় নিজেকে গৃহবন্দি করেছিলেন। পাম অ্যাভিনিউয়ের দু’কামরার ফ্ল্যাট থেকেই খোঁজ রাখতেন বিশ্বের। বৃহস্পতিবার সকালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয়েছে। বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
২০০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব। বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর মৃত্যুর খবর জানান তাঁর সন্তান সুচেতন ভট্টাচার্য। তিনি জানান, সকালেও বুদ্ধদেব প্রাতঃরাশ করেছিলেন। তার পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতেই তিনি প্রয়াত হন। খবর পেয়ে সুচেতন সেখানে পৌঁছান।
সূত্রের খবর, বুধবার রাতে বুদ্ধদেবের শ্বাসকষ্ট বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা রাতে সামাল দেওয়া হয়েছিল। ঠিক করা হয়েছিল, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা নাগাদ উডল্যান্ডসের চিকিৎসকেরা এসে তাঁকে পরীক্ষা করবেন। প্রয়োজনে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে। কারণ, হাসপাতালে যাওয়ার বিষয়টিতে তাঁর ঘোর অনীহা ছিল। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন বুদ্ধদেব। প্রাতঃরাশের পর চা-ও খেয়েছিলেন। তার পরে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে নেবুলাইজ়ার দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সেই সময়েই তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। দ্রুত চিকিৎসকদের খবর দেওয়া হয়। তাঁরা এসে বুদ্ধদেবকে প্রয়াত ঘোষণা করেন।
গত বছরের ৯ অগস্ট হাসপাতাল থেকে বিপন্মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন বুদ্ধদেব। ২৯ জুলাই আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার আলিপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে। বেশ কয়েক দিন তাঁকে ভেন্টিলেশন সাপোর্টে রাখেন চিকিৎসকেরা। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। ফুসফুস এবং শ্বাসনালিতে মারাত্মক সংক্রমণ ধরা পড়ে। হাসপাতালে প্রথম কয়েক দিন মূলত আচ্ছন্ন অবস্থাতেই ছিলেন বুদ্ধদেব। তবে ক্রমশ তিনি চিকিৎসায় সাড়া দেন। ১২ দিনের মাথায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাড়িতে ফিরিয়েও কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে রাখা হয়েছিল তাঁকে।
রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রয়াত
দীর্ঘ দিন ধরেই গুরুতর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা (সিওপিডি)-তে ভুগছিলেন বুদ্ধদেব। অসুস্থতার কারণে শেষ কয়েক বছর কার্যত গৃহবন্দিই ছিলেন। আগেও একাধিক বার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় তাঁকে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। সেই সময়েও কয়েক দিন ভেন্টিলেশনে রাখতে হয় তাঁকে। সেখান থেকে বিপন্মুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন।
২০২১-এর মে মাসের মাঝামাঝি কোভিডে আক্রান্ত হন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ১৮ মে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। একই সময় কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যও। একই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় মীরাকে। দু’জনেই কোভিড নেগেটিভ হয়ে ফেরেন কিছু দিনের মধ্যে।
২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি বুদ্ধদেব সংবাদের শিরোনামে আসেন পদ্মভূষণ প্রত্যাখ্যান করে। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর নাম মনোনীত করলেও, তিনি এই সম্মান নিতে অস্বীকার করেন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবন ও কর্মযাত্রা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ১৯৪৪ সালে জন্ম নেওয়া বুদ্ধদেব একটি বামপন্থী পরিবারে বেড়ে ওঠেন, যা তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের পর ১৯৬৪ সালে সিপিআই থেকে ভেঙে গঠিত হয় সিপিএম। ১৯৬৬ সালে বুদ্ধদেব সিপিএমের সদস্য হন। তখন তিনি ছিলেন একজন বাম-মনস্ক ছাত্র, যার সাহিত্য চর্চার একটি বিশেষ আগ্রহ ছিল।
দলে যোগ দেওয়ার পর বুদ্ধদেব মূলত দলীয় পত্রিকা সম্পাদনা এবং লেখালিখির দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন (ডিওয়াইএফআই)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক হন। খাদ্য আন্দোলন ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রচারেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৭ সালে কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের দায়িত্ব পালন করেন, যা পরবর্তীতে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর নামে পরিচিত হয়। ১৯৮৭ সালে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে জিতে পুনরায় তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী হন।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন, তবে পরে আবার মন্ত্রিসভায় ফিরে আসেন। ১৯৮৪ সাল থেকে বুদ্ধদেব সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য এবং ১৯৮৫ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ২০০০ সালে পলিটব্যুরোর সদস্য এবং ৬ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেন। ২০১১ পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন।
২০০৬ সালে ২৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন। শিল্পায়নের অভিমুখে রাজ্যকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট শোচনীয় পরাজয়ের মুখে পড়ে। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পেশ করা দলিল অনুযায়ী, শিল্পায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা ব্যতিক্রম হিসাবে উল্লেখ করেন তিনি। ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে গুলি চালনায় ১৪ জন গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনা বামফ্রন্ট সরকার প্রশ্নের মুখে ফেলে।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি, সিনেমার প্রতি বুদ্ধদেবের আগ্রহ জীবনের শেষ পর্যন্ত বজায় ছিল। তাঁর নাটক ‘সময়, অসময়, দুঃসময়’ সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরে। ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পরও বুদ্ধদেব দলীয় এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তব্য রেখে গেছেন।