বিহার বিধানসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পথে এগোচ্ছে নরেন্দ্র মোদী–নীতীশ কুমারের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (NDA)। রাজ্যের ২৪৩ আসনের মধ্যে ২০০-র বেশি আসনে এগিয়ে থেকে শাসকজোট গত দু’দশকের অন্যতম শক্তিশালী জনসমর্থন অর্জনের ইঙ্গিত দিয়েছে। ২০১০ সালের ঐতিহাসিক জয়ের ধারা ছাড়িয়ে NDA এবার আরও বড় ব্যবধানে আস্থা পেয়েছে ভোটারদের। এই ফলাফলে ফের স্পষ্ট—বিহারে নীতীশ কুমারের রাজনৈতিক দাপট এখনও অটুট এবং জনতার ভরসা জোটের হাত শক্ত করেছে।
বিজয়ীরা
নীতীশ কুমার
২০ বছরের বেশি সময় ধরে মুখ্যমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও নীতীশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) যে এবারও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকবে, তা ভোটের আগে অনেকেই ভাবেননি। কিন্তু তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাবিরোধিতা কাটিয়েই উঠলেন না, বরং ৮০-র বেশি আসনে লিড নিয়ে NDA-র ২০০ প্লাস মার্ক নিশ্চিত করলেন। ফলে পঞ্চমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসতে চলেছেন তিনি। তেজস্বী যাদবের ‘তরুণ বনাম অভিজ্ঞতা’ তত্ত্ব ভোটে কোনও প্রভাবই ফেলতে পারেনি।
চিরাগ পাসওয়ান
২০২০ সালে মাত্র একটি আসন পাওয়ার পর চিরাগ পাসওয়ানের রাজনীতিকে অনেকে ‘শেষ’ ভেবেছিলেন। কিন্তু এবার ২৯টির মধ্যে ২২ আসনে দুরন্ত ফল করে তিনি NDA-র অন্যতম বড় শক্তি হয়ে উঠেছেন। যুবসমাজ ও দলিত ভোট তাঁর সবচেয়ে বড় ভিত্তি তৈরি করেছে।
আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ও AIMIM
সীমাঞ্চল আবারও AIMIM-এর দৃঢ় ঘাঁটি হয়ে উঠল। আরারিয়া, কিশানগঞ্জ ও পূর্ণিয়ার চারটি আসনে জিতে ওয়াইসির দল তাদের পুরনো শক্তি বজায় রেখেছে। ২০২০ সালের ফলও প্রায় হুবহু পুনরাবৃত্তি হল।
মহিলা ভোটার
এই নির্বাচনের সবচেয়ে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছেন মহিলা ভোটাররা। বিহারের ইতিহাসে প্রথমবার পুরুষদের তুলনায় প্রায় নয় শতাংশ বেশি ভোট দিয়েছেন মহিলারা—৭১.৬% বনাম ৬২.৮%। মহিলাদের উন্নয়ন-নির্ভর প্রকল্প, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনায় ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা NDA-কে বিশাল সুবিধা দিয়েছে।
NDA-র ছোট শরিকরা
জিতনরাম মাঝির HAM, উপেন্দ্র কুশওয়াহার RLM এবং চিরাগ পাসওয়ানের LJP(RV)—তিন শরিকই দারুণ ফল করেছে। HAM ছ’টির মধ্যে পাঁচটিতে, RLM চারটিতে এবং LJP(RV) কুড়িটিরও বেশি আসনে এগিয়ে আশাতীত ফল দিয়েছে।
পরাজিতরা
তেজস্বী যাদব ও RJD
২০২০-র নির্বাচনে নিজের ভাবমূর্তি তুলে ধরে প্রধান বিরোধীর মর্যাদা পেয়েছিলেন তেজস্বী যাদব। কিন্তু এবার ১৯ আসনে সীমাবদ্ধ হয়ে RJD তার ইতিহাসের দ্বিতীয় সবচেয়ে খারাপ ফল দেখল। রাঘোপুরে জিতলেও রাজ্যের ভোটারদের আস্থা ধরে রাখতে ব্যর্থ তেজস্বী।
রাহুল গান্ধী
কংগ্রেস আবারও বিহারে ভরাডুবি করেছে। এক অঙ্কের আসনে সীমাবদ্ধ থেকে ২০২০ সালের ধারাবাহিক ব্যর্থতা বজায় রেখেছে দলটি। ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’, ভোট চুরির অভিযোগ অথবা SIR বিরোধী আন্দোলন—কোনো কিছুই ভোটে প্রভাব ফেলতে পারেনি।
প্রশান্ত কিশোর
দুই বছরের পদযাত্রা, বিপুল প্রচার, উন্নয়ন–ভিত্তিক দাবি—কোনো কিছুই কাজে লাগল না। জন সুরাজ পার্টি NOTA-র থেকেও কম ভোট পেয়ে শূন্যে এসে দাঁড়াল। দীর্ঘদিন ধরে দেশের শীর্ষ স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে পরিচিত পিকে সরাসরি রাজনীতির ময়দানে একেবারে ব্যর্থ হলেন। তাঁর ভোটে না-নামা আরও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে ভোটারদের মাঝে।
মুকেশ সাহানি
নিশাদ ভোট ব্যাংককে লক্ষ্য করে প্রচারে নামলেও কোনও আসনে প্রত্যাশিত ফল দিতে পারলেন না তিনি। মহাজোট তাঁকে ডেপুটি সিএম মুখ করে প্রচার করলেও ফলাফলে তা কোনো সুবিধা এনে দেয়নি। নিশাদ ভোটের বড় অংশ NDA-র দিকে সরে গিয়েছে।
INDIA জোট
বিহারের এই ফল ২০২৫-এর বাকি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলির নির্বাচনের আগে INDIA জোটের জন্য বড় ধাক্কা। জোটে মতবিরোধ, নেতৃত্বের অনিশ্চয়তা, বার্তা পৌঁছে না দেওয়া—সব মিলিয়ে বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
NDA যেখানে ২০৪ আসনে এগিয়ে, সেখানে বিরোধী শিবির মাত্র ৩২ আসনে সীমাবদ্ধ। কংগ্রেস এক অঙ্কে, RJD পিছিয়ে, বাম দলগুলো প্রভাব হারিয়েছে।
বিহার বিধানসভা নির্বাচনের এই ফল স্পষ্টভাবে তুলে ধরল—রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণে NDA-র দাপট অটুট। নীতীশ–মোদী জুটির উন্নয়নমুখী প্রচার, মহিলা ভোটারদের দৃঢ় সমর্থন ও জোটশরিকদের সাফল্যে বিরোধীরা কার্যত ছিন্নভিন্ন।
২০২৫ সালের নির্বাচনী মরসুমের প্রথম বড় লড়াইয়ে NDA যে শক্ত অবস্থান তৈরি করল, তা আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতিতেও বড় প্রভাব ফেলবে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
