শ্রয়ণ সেন
রেকর্ড গড়ে ফেলল মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপাল। শুক্রবার ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে শনিবার ভোর সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত শহরে বৃষ্টি হয়েছে ২৯৭ মিমি। ভোপালের ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ। শুধু ভোপাল নয়, গত চার-পাঁচ দিনে ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে রাজ্যের সাতনা, পাঁচমাড়ি, নরসিংহপুর, হোসাঙ্গাবাদেও। গত তিন দিনের চলা এই তুমুল বৃষ্টির ফলে বন্যার সম্মুখীন হয়েছে রাজ্যের ২৩টি জেলা। ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ২০ জন। এর মধ্যে ভোপাল শহরে ৬ জন। বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে নর্মদা, মন্দাকিনী, সোন আর তামাস নদী। গোটা রাজ্যে বর্ষা এখন প্রায় ৮০ শতাংশের মতো বাড়তি।
রেকর্ড গড়ে ফেলল চেরাপুঞ্জিও। বর্ষার মরসুমের দেড় মাস হতে চলল এখনও সে ভাবে বৃষ্টির দেখা নেই দেশের সর্বাধিক বৃষ্টি হওয়া এই শহরে। চেরাপুঞ্জিতে এখন বৃষ্টির ঘাটতি ৫১ শতাংশ।
ভারতের সরকারি আবহাওয়া সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা আর অনেক বিদেশি আবহাওয়া সংস্থার পূর্বাভাস মিলিয়ে দুর্দান্ত ইনিংস শুরু করেছে বর্ষা। ভালো বৃষ্টি পাচ্ছে খরা-কবলিত রাজ্য মহারাষ্ট্র আর কর্ণাটক। ৯ই জুলাই পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের শুখা অঞ্চল মরাঠাওয়াড়ে বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের ৫ শতাংশ বেশি। অন্য দিকে আরও এক শুখা অঞ্চল, চাষিদের আত্মহত্যার জন্য কুখ্যাত বিদর্ভে বৃষ্টি এখন ৩৪ শতাংশ বাড়তি। কর্ণাটকেও বৃষ্টি এখনও পর্যন্ত স্বাভাবিকের থেকে ১৫ শতাংশ বেশি। দেশের পশ্চিম উপকূলেও বৃষ্টি একদম স্বাভাবিক। মুম্বই-সহ সমগ্র কোঙ্কণ উপকূলে স্বাভাবিকের থেকে ২৪ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। উত্তর ভারতেও বর্ষার পরিস্থিতি আপাতত স্বাভাবিক। সমগ্র উত্তর ভারতে ৯ই জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের থেকে ৭ শতাংশ বেশি। অস্বাভাবিক বৃষ্টির ফলে বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন জেলা। কোথাও নেমেছে ধস, কোথাও ভেঙেছে ঘরবাড়ি। দক্ষিণ ভারতেও বৃষ্টি স্বাভাবিক। স্বাভাবিকের থেকে ১১ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে এই অঞ্চলে।
কিন্তু বেশ খারাপ অবস্থা দেশের পূর্বাংশে। বিশেষ করে উত্তরপূর্ব ভারতে। জুনের শেষ পর্যন্তও দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির ঘাটতি ছিল ৩১ শতাংশ। জুলাইয়ের শুরুতে একটি নিম্নচাপের প্রভাবে ভালো বৃষ্টি হওয়ায় সেই ঘাটতি এখন নেমে এসেছে ১৪ শতাংশে। ওই নিম্নচাপের জন্য বৃষ্টির ঘাটতি কমিয়ে ফেলেছে বিহার আর ঝাড়খণ্ডও। যদিও বর্ষার শুরু থেকেই জোর বৃষ্টি হওয়ায় উত্তরবঙ্গে এখন বৃষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে ৮ শতাংশ বেশি। তবে তথৈবচ অবস্থা অসম-মেঘালয়ের। এখানে ঘাটতি ৩৭ শতাংশ। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরায় ঘাটতি ৩২ শতাংশ। সাধারণত এই উত্তরপূর্ব ভারতেই সব থেকে বেশি বৃষ্টি হয়। এত কম বৃষ্টি হওয়ার পেছনে রয়েছে তিনটে কারণ। এক নম্বর, বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ। এই মরসুমে এখনও পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপগুলি ওড়িশা-দক্ষিণবঙ্গ উপকূল দিয়ে ঢুকে মধ্য ভারতের দিকে চলে যাচ্ছে। নিম্নচাপগুলি যদি মধ্য ভারতের দিকে না গিয়ে উত্তরপূর্ব ভারতের দিকে আসত তা হলেই বৃষ্টি বাড়ত এই অঞ্চলে। দ্বিতীয় কারণ, নিম্নচাপ অক্ষরেখা হিমালয়ের পাদদেশ সংলগ্ন অসমে থিতু হতে পারছে না। বর্ষার মরসুমের বেশির ভাগ সময়েই এই অক্ষরেখা অসম-মেঘালয়ে থাকাই বাঞ্ছনীয়। তৃতীয় কারণ, উত্তর পূর্ব ভারতে ঘূর্ণাবর্তের অনুপস্থিতি।
ঘূর্ণাবর্ত আর নিম্নচাপ অক্ষরেখা বঙ্গোপসাগর থেকে মেঘ টেনে আনে। সেই মেঘ বাংলাদেশের সমতলের ওপর দিয়ে বাধাহীন ভাবে বয়ে গিয়ে প্রথম ধাক্কা খায় চেরাপুঞ্জি সংলগ্ন খাসি পাহাড়ে। সেখানেই সেই জল ভরা মেঘ ভেঙে যায়। নামে প্রবল বৃষ্টি। বৃষ্টির তীব্রতা এতটাই বেশি হয় যে কখনও টানা চার-পাঁচ দিনও বৃষ্টি হয় এখানে। এক দিনে চারশো, পাঁচশো তো বটেই এমনকি হাজার মিলিমিটারের বৃষ্টিরও অভিজ্ঞতা আছে চেরাপুঞ্জির। সেখানে এ বার চল্লিশ, পঞ্চাশ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হচ্ছেই না। ১লা জুন থেকে ৯ই জুলাই এখানে বৃষ্টি হওয়ার কথা ৩৬২৫ মিমি। হয়েছে মাত্র ১৭৭১ মিমি।
পূর্বাভাস কী বলছে ?
এই মুহূর্তে দক্ষিণবঙ্গের ওপরে একটি ঘূর্ণাবর্ত অবস্থান করছে। এর প্রভাবে গত দু’ দিনে কমবেশি ভালোই বৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়। আগামী ৪৮ ঘণ্টাতেও এই ঘূর্ণাবর্তের প্রভাব থাকবে। বৃষ্টি চলবে দক্ষিণবঙ্গে। মার্কিন আবহাওয়া সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যের বিশ্লেষণে বোঝা যাচ্ছে উত্তরপূর্ব ভারতের পক্ষে আগামী দু’ সপ্তাহ যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। ১৫ জুলাই পর্যন্ত ভারী বৃষ্টি হতে পারে উত্তরবঙ্গ আর অসমে। ১৫ থেকে ২১ জুলাই ভারী বৃষ্টির পরিধি আরেকটু বেড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরাতেও। তবে দেশের বাকি অংশে বৃষ্টির পরিমাণ কমতে পারে। কোঙ্কণ উপকূল আর কর্ণাটক উপকূল ছাড়া ভারতের আর কোনও অংশেই ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় এই সময়কে বলে ‘ব্রেক মনসুন’।
এখন দেখার আগামী দু’ সপ্তাহের বৃষ্টির ফলে কতটা ঘাটতি কমাতে পারে উত্তরপূর্ব ভারত। নিজের গৌরব কি ফেরাতে পারবে চেরাপুঞ্জি ?
ছবি: সৌজন্যে দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।