কলকাতা: ২০২১ সালের রাজ্য বিধানসভা ভোটে শহর থেকে গ্রামেগঞ্জে নজরে এড়ায়নি সেই পোস্টার। ‘নো ভোট টু বিজেপি’। ভোটের ফলাফলেও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ‘পদ্ম’ পছন্দ নয় বাংলার। মঙ্গলবার কেন্দ্রের তরফে পদ্ম সম্মানের তালিকা প্রকাশের পর একে একে তা প্রত্যাখান করেছেন বাংলার তিনজনই। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সম্মানের সঙ্গে কেন্দ্রের শাসক দলের ফারাক তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি এমন প্রশ্নও উঠছে, তা হলে কি বিধানসভা ভোটের সময় থেকে বাংলায় আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক মেরুকরণের ছোঁয়াও রয়েছে এতে?
অনাকাঙ্ক্ষিত নয়
বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কঠোর সমালোচন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভটাচার্যের নাম ছিল এ বারের পদ্মভূষণ সম্মানপ্রাপকের তালিকায়। পত্রপাঠ তা প্রত্যাখান করেছেন প্রাক্তন কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী। এটা যে অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, সেটাও নির্ধারিত ছিল তাঁর পূর্বসূরির পদক্ষেপে। এর আগে আরেক কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়ার কথা হলে, সেই সময়ে তিনি ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

ফলে বিষয়টির গভীরতা অনেক হলেও রাজনৈতিক মহিমায় কোনো জটিলতা নেই। পদ্মভূষণ দেওয়ার কথা ঘোষণা হওয়ার পরেই বিবৃতি দিয়ে বুদ্ধদেববাবু জানান, “পদ্মভূষণ পুরস্কার নিয়ে আমি কিছুই জানি না, আমাকে এই নিয়ে কেউ কিছু বলেনি। যদি আমাকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দিয়ে থাকে তা হলে আমি তা প্রত্যাখ্যান করছি”। অন্য দিকে, আরও স্পষ্ট করে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেছেন, “উনি সম্মান প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। সেটা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে কমিউনিস্টরা চির দিন দেশের পরম্পরা-সংস্কৃতিকে অপমান করেছে”।
এত দিন পরে?
১৯৭০ সালে শ্রেষ্ঠ মহিলা নেপথ্য গায়কের জন্য একটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তিনি এখন নবতিপর। দীর্ঘদিন ধরে বাংলার অন্যতম সেরা কণ্ঠশিল্পীকে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পুরস্কার “বঙ্গবিভূষণ” দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার কেন্দ্রের তরফে পদ্মশ্রী খেতাবে সম্মানিত করার প্রস্তাবকে প্রত্যাখান করেছেন গীতশ্রী।

সন্ধ্যা-কন্যা সৌমি সেনগুপ্ত কোনো রাখঢাক না করেই বলেছেন, “পদ্মশ্রী একজন জুনিয়র আর্টিস্টের জন্য বেশি মানানসই, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্য নয়। তাঁর পরিবার এবং তাঁর গানের অনুরাগীরা তেমনটাই মনে করেন”। এখানেই না থেমে যেতে পারত বিতর্ক। কিন্তু সৌমি যখন বলেন, এই বয়সে এ ধরনের পুরস্কারে শিল্পী ‘অপমানিত’ বোধ করছেন, তখন তাঁর মর্যাদার পাশাপাশি এই প্রত্যাখানকে বঞ্চনার বিরুদ্ধে যোগ্য ‘জবাব’ও ধরে নেওয়া যেতে পারে। মেলাতে হয় প্রথম বারের বঙ্গভূষণ থেকে শুরু করে বাংলা সংগীতমেলায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গীতশ্রীর উজ্জ্বল উপস্থিতির ছবিও। স্পষ্ট হয়, হতাশা আর অপমানের বেদনার ‘জবাব’ কাকে দেওয়া যায়!
পদ্মে অনীহা অনিন্দ্যর
ফারুখাবাদ ঘরানার তবলাশিল্পী তবলাশিল্পী পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় নিজের জগতে ইতিমধ্যেই প্রবাদপ্রতিম। পদ্মসম্মানের তালিকা প্রকাশ্যে আসার পরই তিনিও বলেছেন, তাঁর ক্ষেত্রেও পদ্মশ্রী পুরস্কার পাওয়ার সময় পেরিয়ে গিয়েছে। অনেক দিন আগেই তাঁর পদ্মশ্রী পাওয়া উচিত ছিল।

কয়েক দশক আগে থেকেই ধ্রুপদী সঙ্গীতজগতে অত্যন্ত নামকরা অনিন্দ্য। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি শঙ্কর, আলি আকবর খান, আমজাদ আলি খানের মতো শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই, এই প্রস্তাবে তিনি আহত ও অসম্মানিত বোধ করছেন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান, শাস্ত্রীয় সংগীত জগতে তাঁর যা অবদান তার সমস্ত নথি কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে রয়েছে। সেখানে সকলেই তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মান দেওয়ার কথা বলেছেন। সেই জায়গায় পদ্মশ্রী?
সেই ‘পদ্ম’-ই!
সব মিলিয়ে কেন্দ্রের দেওয়া সম্মান প্রত্যাখ্যানে কেউ দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত কারণ, কেউ অসন্তোষ! শেষ বিধানসভা ভোটে আচমকা ভোটের হার বাড়িয়ে নিলেও অনাঙ্ক্ষিত ফলের মুখোমুখি হয় বিজেপি। এখন আবার বঙ্গ বিজেপির গা থেকে ক্রমশ ‘ছাল’ খসে পড়ছে, তেমনটাই বলতে শোনা যায় প্রাক্তন রাজ্য সভাপতিকে। একুশের ভোট থেকে বাইশের সম্মান, মাঝখানে কিন্তু সেই ‘পদ্ম’-ই!
আরও পড়তে পারেন:
পদ্মশ্রী সম্মান ফিরিয়ে দিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
সামাজিক ক্ষেত্রে অবদানের জন্য পদ্মভূষণ, প্রত্যাখ্যান করলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।