খবরঅনলাইন ডেস্ক: গোয়ার বাসিন্দা বছর ২৬-এর স্যাম ন্যাথান এখন খুব ব্যস্ত মানুষ। লকডাউনের সময়ে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর কারণে নিজের বাড়িতেই ফিরে আসেন তিনি। এখনও গোয়াতেই রয়েছেন, কিন্তু কাজ বেড়ে গিয়েছে। সব কিছু করার জন্য সময়েও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি।
তিনি পথনাটিকার স্ক্রিপ্ট লিখছেন, রাস্তায় নাচের মধ্যে দিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন। এমনকি গভীর রাতে আন্দোলনের জন্য জঙ্গলেও যাচ্ছেন তিনি। স্যাম বলেন, “আমি আগে সৈকত ছাড়া গোয়ার অন্য কোথাওই যাইনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, যে বড়ো একটা কিছু ব্যাপারের শরিক হয়ে গিয়েছি আমি।”
ভারতের অন্যতম সেরা ‘হলিডে ডেসটিনেশন’ গোয়ায় এখন কী চলছে, অনেকেই জানেন না। জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলি সামান্য কিছু খবর প্রকাশ করলেও বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক খবরে কিছুই বলা হচ্ছে না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ জানতে পারছেন না।
এই মুহূর্তে বড়ো রকমের পরিবেশ আন্দোলন আছড়ে পড়েছে গোয়ায়। যার নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক দল নেই, বরং সাধারণ মানুষ, বিশেষত যুব সম্প্রদায় রয়েছে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে গিয়ে গ্রেফতারও হতে হয়েছে কয়েক জন প্রতিবাদীকে। কিন্তু তাতেও দমতে রাজি নয় গোয়া।
প্রথমে জেনে নেওয়া দরকারি ঠিক কী কারণে প্রতিবাদে গর্জে উঠছে গোয়া। এর পেছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটে উন্নয়নমূলক প্রকল্প।
১) কর্নাটকের হসপেট থেকে গোয়ার ভাস্কো পর্যন্ত ১২০ বছরের পুরোনো রেলপথকে ডবল লাইন করা।
২) ৪এ জাতীয় সড়ক চার লেন করার প্রকল্প।
৩) ৪০০ কেভি বৈদ্যুতিন লাইন।
কিছু দিন আগেই এই তিনটে প্রকল্পের ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী এই তিনটে প্রকল্পই সাগরমালা বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্গত। গোয়ার মর্মুগাও পোর্ট ট্রাস্ট থেকে কয়লা পরিবহণ যাতে সহজে হয়, সে কারণে এই রেল এবং সড়ক প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চলেছে কেন্দ্র।
রাজ্য সরকারের বক্তব্য
রাজ্যের শাসক তথা বিজেপির বক্তব্য, এই তিনটে প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে ব্যাপক উন্নয়ন হবে গোয়ার। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে ফলে রাজ্যে আরও বেশি পর্যটকের আগমন হবে। বিদ্যুতের এই লাইনের ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভর হবে গোয়া। ফলে মহারাষ্ট্র আর কর্নাটকের ওপরে বিদ্যুতের জন্য ভরসা করতে হবে না গোয়াকে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে রাজ্যে বড়ো বড়ো শিল্পগোষ্ঠী আসবে বলে রাজ্যের বক্তব্য। এর ফলে কর্মসংস্থান আরও বাড়বে। সিআইআইয়ের ন্যাশনাল একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য নীতিন কুনকোলিয়েনকর বলেন, “সড়ক এবং রেল ব্যবস্থা উন্নত করে রাজ্য যদি আরও শিল্পগোষ্ঠীকে আমন্ত্রণ জানাতে পারে, তা হলে আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে।”
প্রতিবাদীদের বক্তব্য

কিন্তু প্রতিবাদীরা জানাচ্ছেন, এই তিনটে প্রকল্পের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে লকডাউনের সময়ে। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই এই প্রকল্পগুলোর জন্য গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদীদের বক্তব্য, সাধারণ মানুষের লাগাতার আন্দোলন এড়ানোর জন্যই লকডাউনের সময়ে চুপিসারে এই কাজ করা হয়েছে।
পরিবেশের কী ক্ষতি হবে?
গোয়ার সব থেকে বড়ো সম্পদ হল তার জঙ্গল। জানা গিয়েছে, এই প্রকল্পগুলির কারণে রাজ্যের দু’টি প্রধান বনাঞ্চল– মোল্লেম জাতীয় উদ্যান এবং ভগবান মহাবীর অভয়ারণ্যের অন্তত ১৭০ হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া যে জঙ্গল অবশিষ্ট থাকবে, সেটাও চারটে ছোটো ছোটো জোনে ভাগ হয়ে যাবে।
সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস করে প্রকল্পের কাজ করার যুক্তিটা ঠিক কোথায় সেটা স্পষ্ট ভাবে জানতে চেয়ে গত ২৯ জুন কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরকে চিঠি দেয় ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশন অব গোয়া (টিটিএজি)। গোয়ার পর্যটনের একটি নোডাল এজেন্সি হল এই টিটিএজি।
টিটিএজির বক্তব্য, মোল্লেম জাতীয় উদ্যান এবং ভগনাম মহাবীর অভয়ারণ্য দু’টোই প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটনের আদর্শ জায়গা। দু’টো জায়গাই প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত পছন্দের। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এই বনাঞ্চল ধ্বংস হলে পর্যটনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
এই দু’টি জাতীয় উদ্যান এবং তার আশেপাশের পাহাড়ি অঞ্চল কর্নাটকের কালি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে গোয়ার মধ্যে বাঘের করিডোর হিসেবে কাজ করে। এই অঞ্চলটা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং বিশ্বের মোট বাঘের ১৭ শতাংশেরই বাস এই অঞ্চলে।
গোয়ার পরিবেশগত একটি পর্যবেক্ষণ গোষ্ঠী হল গোয়া ফাউন্ডেশন। তার ডিরেক্টর ক্লড অ্যালভ্যারেজ বলেন, “এই পাহাড়ি অঞ্চলকে ব্যাঘ্র প্রকল্প ঘোষণা করার দাবি অনেক দিনের। এটা যদি ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হয় তা হলে বন্যজন্তুদের চলাচলে ব্যাপক প্রভাব পড়তে। এতে বাঘের জনসংখ্যা তো কমবেই, গোটা এলাকার বাস্তুতন্ত্রও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এই পাহাড়ি অঞ্চল গোয়ার শ্বাসযন্ত্র হিসেবে কাজ করে। এটাকে ধ্বংস করতে দেওয়া যাবে না। সরকারকে উন্নয়নের জন্য অন্য বিকল্প পথ খুঁজতে হবে।”
আন্দোলনের নেতৃত্বে যুবসম্প্রদায়
পরিবেশ রক্ষার জন্য এর আগেও অনেক আন্দোলন দেখেছে গোয়া। সেগুলো সফলও হয়েছে। কিন্তু এ বার আন্দোলনের চরিত্র একটু আলাদা।
আগেকার দিনের আন্দোলনগুলোতে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল সামনে থেকে নেতৃত্ব দিত। কিন্তু এ বার আন্দোলন হচ্ছে কোনো রাজনৈতিক পতাকা ছাড়াই। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছেন রাজ্যের যুবসম্প্রদায়।
আন্দোলনের ধরনও অন্য রকম। সহিংস আন্দোলন হয়নি। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনে প্রতিবাদীদের হাতিয়ার পথনাটিকা, স্ট্রিট ডান্স, মোমবাতি মিছিল। সেই সঙ্গে বিশাল ভাবে সক্রিয় রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াও। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়মিত আপডেট করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতনতা বাড়ানোর জন্য #mymollem.goa, #mymollem জাতীয় হ্যাশট্যাগ তৈরি করা হয়েছে। অ্যালভ্যারেজ এই প্রসঙ্গেই বলেন, “যুব সম্প্রদায় এটার নেতৃত্বে রয়েছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা ওরাই তৈরি করছে। বয়স্ক এবং অভিজ্ঞরা তাদের সর্বতো ভাবে পেছন থেকে সমর্থন করে চলেছে।
আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এফআইআরও হয়েছে। কিন্তু তাতেও তারা দমবার পাত্র নয়। বরং তারা নিজেরাই সানন্দে গ্রেফতার বরণ করতে প্রস্তুত। আর সে কারণে নভেম্বরের শুরুতে #ArrestMeToo হ্যাশট্যাগটিও ট্রেন্ড করতে শুরু করে।
সমাজকর্মী সিসিল রডরিগেজ বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক লাভ হচ্ছে এই আন্দোলনের। সমাজের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। অনেক সেলিব্রেটিও বিভিন্ন ভাবে এই আন্দোলনের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন।”
কী ভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়
সোশ্যাল মিডিয়ায় এই আন্দোলন কী ভাবে হচ্ছে, সেটা জানার জন্য টুইটারে কয়েকটি পোস্ট তুলে ধরা হল
আগের সফল আন্দোলনগুলির ইতিহাস
এটাই প্রথম নয়, গোয়ায় এর আগেই পরিবেশ রক্ষার্থে অনেক আন্দোলন হয়েছে। আর তা সফলও হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে কোঙ্কণ রেলের সম্প্রসারণের পরিকল্পনা এই আন্দোলনের জেরেই থমকে যায়। একাধিক শিল্প কারখানাও বন্ধ করে দিতে হয় এই আন্দোলনের জেরে। সব ক্ষেত্রেই অভিযোগ ছিল পরিবেশ ধ্বংসের।
উত্তর গোয়ার মোপায় একটি বিমানবন্দর তৈরির কাজ হচ্ছে। সেটার বিরুদ্ধেও আন্দোলন সংঘবদ্ধ হচ্ছে। গোয়ায় ওলা-উবেরের মতো অ্যাপ ভিত্তিক ক্যাবপরিষেবা নেই। এর প্রধান কারণ হল রাজ্যের ট্যাক্সি অপারেটরগুলির প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-আন্দোলন।

গোয়ার জনসংখ্যা কম বলে সরকার মানুষের কথা শুনতে বাধ্য বলে মনে করেন রাজ্যের একটি কলেজের সমাজবিদ্যার এক অধ্যাপক। তাঁর কথায়, “জনসংখ্যা যে হেতু অল্প, তাই এই রাজ্যের সরকারের কাছে ভোট হারানোর ভয়টা থাকে। সে কারণে এখানে সাধারণ মানুষের কথা শুনতে বাধ্য হয় সরকার।”
অধ্যাপকের এই কথাগুলিই এখন গোয়ার আশা এবং ভরসা। তাদের একটাই দাবি, পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন তারা চায় না। এই কর্মযজ্ঞ বন্ধ হোক রাজ্যে, রক্ষা পাক গোয়ার জঙ্গল।
খবরঅনলাইনে আরও পড়তে পারেন