যার যার জাতের ধারা, ভাত গলায় দিয়ে মরে তারা

0
Utpalendu Mondal 1 1

উৎপলেন্দু মণ্ডল

স্বাধীনতার ৭৫-এ দলিত দমন খুবই স্বাভাবিক, আমাদের স্বাধীনতা এমনই। সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে আজও ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী। সরকার আসে সরকার যায়। মায়াবতী, দ্রৌপদীরা মসনদে বসেন। কিন্তু দলিতের ভাগ্য লিখনের পরিবর্তন দূরাগত—আম্বেডকর, জগজীবন রাম, দ্রৌপদী মুর্মুরা চেয়ারে বসে আছেন অথবা একদা ছিলেন, তবে তাতে কিছুই যায়-আসে না।

সমাজের ব্রাত্য অংশের লোকেরা পিরামিডের নীচের অংশ। ওদের দেখেই বলে, ‘ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছি ও যে চণ্ডালিনীর ঝি’। ওরাই মেয়ে হলে লাঞ্ছিত, ধর্ষিত হতে পারে। ছেলে হলে পদে পদে অপমানিত, নিগৃহীত। সারাজীবন এটাই যেন নিয়তি। ভারতবর্ষের নিয়তি। বিবেকানন্দ, আম্বেডকর, জগজীবন রাম—কেউই আটকাতে পারেননি।

দেশভাগের পর যোগেন মণ্ডল পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে গিয়েছিলেন। মুসলিমদের সঙ্গে একাত্মবোধ করেছিলেন। পরে অবশ্য এ পারে চলে এসেছিলেন। তার নাতি এখন দলিত আকাদেমির সদস্য।

‘জল দাও জল দাও’

আসল দোষ ঐতিহ্যগত, পরাম্পরাগত ভাবে সমাজের বড়ো অংশ দলিতদের সহ্য করতে পারে না। মৃত্যুর লম্বা সারি, ধর্ষণের সময়—হসপিটাল ও প্রশাসনের নীরব নিভৃত দোলাচল চুপচাপ দেখে অ-দলিত সমাজ। প্রকৃত প্রাকৃতজনেরা দিশাহারা। ‘চণ্ডালিকা’য় ‘জল দাও জল দাও’ বলে যে সন্ন্যাসী প্রার্থনা করে বলে, ‘যে মানব আমি সেই মানব তুমি’ এতে কিছু যায়-আসে না—দলিত নিধন চলতেই থাকবে। আমাদের সেমিনার-জীবীরা জলের বোতল নিয়ে চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খাবে আর লেকচার দেবে।

ন’বছরের ছেলেটি পিপাসার্ত। সে তালিকার মানুষ। মাস্টার শুনবেন কেন? রাজস্থানে এমনিতেই জলের অপ্রতুলতা। মেয়েরা কলসির উপর কলসি বসিয়ে জল নিয়ে যায় রাজস্থানে। জলের জন্য এমনিতে লড়াই। সাংবাদিক পি সাইনাথ কবেই বলে দিয়েছেন। সুতরাং জলের জন্য মরবে এটাই তো স্বাভাবিক। জলের অপর নাম জীবন। বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গিয়েছে উষ্ণায়ন, আর সঙ্গে চলে গিয়েছে পাহাড়, বন—সুতরাং বৃষ্টি উধাও, উধাও মানবিকতা, সব জায়গাতে তো সিবিআই লাগানো যায় না। আজ এই উনবিংশ শতাব্দীতে ন’বছরের বালক শুধুমাত্র দলিত হওয়ায় জল, পিপাসার জল পেল না। এদের চৈতন্যের গোড়ায় কে জল দেবে? আইন, দলিত আন্দোলন—সবই মায়াবৎ।

সইলে সম্পত্তি নইলে বিপত্তি

এ সেই ভারত, যেখানে এয়ারপোর্টের পাশে থাকে বুভুক্ষু শিশুর দল। এই সেই দেশ স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ পরে জাতপাতের দোহাই দিয়ে জল ছুঁতে দেয় না। কোথাও আবার দলিত বলে ধর্ষণ হওয়া অনিবার্য। এই স্বত:সিদ্ধ মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি আছে। হ্যাঁ, রাষ্ট্র যদি এগিয়ে না আসে, পদক্ষেপ না নেয়, এ সব চলতেই থাকবে। চারপাশে ‘গৈরিক হাওয়া’, বিরোধী হাওয়া মোরগও চুপ। রাজীব গান্ধী পুত্রকেও কথা বলতে শুনলাম। তা হলে কি ফিটিং হয়ে গেছে, হলেই বিপত্তি। কবেই বা নীচু জাতের কাছে প্রমাণ হয়েছে ‘সইলে সম্পত্তি নইলে বিপত্তি’। বিপত্তি সবসময়—সাদা-কালো ছবি প্রবহমান।

যা হোক করে ভেসে থাকা

পশ্চিমবঙ্গেও কম নয়, একশো দিনের কাজের টাকা মারে মূলত দলিতদের। বাইরে অথবা জেলের ভিতরে আস্ফালন করে চোরেরা। এই তো এখানে আইএএস, আইপিএস-দের নাম ধরে ডাকেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ, সুন্দরবন থেকে, দুই ২৪ পরগনা থেকে, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর—সোনার বাংলা ছেড়ে ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছে লাখে লাখে। সেখানে তারাও কম-বেশি উৎপীড়িত ও নিগৃহীত হচ্ছে। সারাদিন কাজে শেষে দেখেছি, ওপরওয়ালা জানিয়ে দিয়েছে, ও তালিকাভুক্ত লোক। কলিগরাও রসিকতার ছলে চিহ্নিত করে, তুমি তালিকাভুক্ত। তোমার কোনো অগ্রপশ্চাৎ নেই, তুমি তালিকার- তুই কুঞ্জের বাইরের লোক। কুঞ্জের মধ্যে বসে বলতে পারে—’যা করো তা করো রাই, আমরা কুঞ্জের বাইরে যাই’।

পশ্চিমবঙ্গ ভারতে, এখন তাই ভাবা প্র্যাকটিস করা থাক। ভোটের মোহিনী মায়ায়—সব দলিতকে একছাতায়, এক ব্যালটে পুরে দিতে পারে আমাদের রাজ্য। আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা—পুজোসংখ্যায় লিখতে ব্যস্ত। চার দিকে ‘চোর চোর’ শব্দ। এ রাজ্যের দলিতরা নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যা হোক করে ভেসে আছে। আগামী দিনেও থাকবে।

*মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

আরও পড়তে পারেন: আম্বেডকর হোন বা শিক্ষকের মারে মৃত ৯ বছরের ইন্দ্র, দলিতদের আবার কীসের স্বাধীনতা!

বিজ্ঞাপন