সাধনা দাস বসু
গুজরাতের ধরসানার দিকে এগিয়ে চলেছেন আড়াই হাজার সত্যাগ্রহী। সেখানকার লবণ কারখানা ও গুদাম দখল করে আইন অমান্য করার উদ্দেশ্যে। তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পঞ্চাশোত্তীর্ণ এক বঙ্গললনা। পুলিশ সত্যাগ্রহীদের পথ আটকাল। বাধা উপেক্ষা করে সত্যাগ্রহীদের এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন দলনেত্রী। পুলিশ এ বার তাঁকে ও তাঁর সঙ্গীদের নির্দয় ভাবে মারধর শুরু করল। তাতেও না দমে বীরবিক্রমে এগিয়ে চললেন তিনি। পুলিশ বুঝতে পারে আন্দোলনের নেত্রীকে গ্রেফতার না করলে সত্যাগ্রহীদের থামানো যাবে না। অবশেষে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। লাঠি চালিয়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে সরকার ধরসানার কারখানা ও গুদাম রক্ষা করে।
ধরসানা লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের এই অসমসাহসী নেত্রী হলেন সরোজিনী নায়ডু (Sarojini Naidu)। আজ যখন ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ (azadi ka amrit mahotsav) উদযাপিত হচ্ছে, তখন এই সাহসী ও দৃঢ়চেতা নারীকে স্মরণ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।
গুজরাতের ডান্ডিতে সমুদ্রের জল থেকে লবণ তৈরি করে আইন অমান্য করার পড়তে এবং ধরসানার আন্দোলন সংগঠিত করার আগেই ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধীকে গ্রেফতার করে। এর পর আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন আব্বাস তৈয়বজি। পুলিশ তাঁকেও গ্রেফতার করলে আন্দোলনের চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন সরোজিনী।
সরোজিনী এক অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, বাগ্মী, সমাজসেবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ ও দক্ষ প্রশাসক। জন্ম ১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হায়দরাবাদে। বাবা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষাবিদ, হায়দরাবাদ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, যার পরে নাম হয় নিজাম্স কলেজ। সরোজিনীর কবি হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে তাঁর মায়ের অবদান। মা বরদাসুন্দরী দেবী বাংলাভাষায় সুন্দর কবিতা লিখতেন। আট ভাইবোনের মধ্যে সরোজিনী ছিলেন সবার বড়ো। তাঁর এক ভাই বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং আর-এক ভাই হারীন্দ্রনাথ ছিলেন নাট্যকার, অভিনেতা।
মাত্র ১২ বছর বয়সে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সরোজিনী। পরে লন্ডনের কিংস কলেজে এবং কেমব্রিজের গার্টন কলেজে পড়াশোনা করেন। বিদেশে থাকতে থাকতেই সরোজিনীর পরিচয় হয় ডাক্তার মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নাইডুর সঙ্গে। এই পরিচয় থেকেই পরিণয়। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই বিয়ে হয় সরোজিনীর। ডা. নাইডুকে বিয়ে করাটা ছিল সরোজিনীর কাছে ছিল এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। সরোজিনীর বাবা অঘোরনাথ ছিলেন প্রগতিশীল। তিনি এই বিয়েতে সব সময় সরোজিনীর পাশে ছিলেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় সরোজিনী স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। এই সময় কংগ্রেসের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলের পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ – এই চার বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে মেয়েদের অধিকার ও তাদের সশক্তিকরণ, সমাজকল্যাণ, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে থাকেন। তাঁর বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শুধু লেখাপড়া শেখাই নয়, মেয়েরা দেশের কাজেও ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে।
ধীরে ধীরে সরোজিনী নাইডু আরও বেশি করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অনুগামী হয়ে ওঠেন। ১৯২৫ সালে কানপুরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে সরোজিনী নাইডু সভাপতিত্ব করেন। এই পদ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানের। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পূর্ণ ক্ষমতা ছিল। পুরো একটা বছর ধরে দেশের জন্য সভাপতিতে নানা রকম গঠনমূলক কাজ করতে হত। সরোজিনী নাইডু ক্রমশই এক দক্ষ সংগঠক হিসাবে সুনাম অর্জন করেন। ১৯২৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব আফ্রিকার ভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনেও তিনি সভাপতিত্ব করেন।
১৯৩১ সালে মহাত্মা গান্ধী গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে ব্রিটেনে যান। তাঁর সঙ্গী ছিলেন মদনমোহন মালব্য ও সরোজিনী নাইডু। অসহযোগ আন্দোলনে সরোজিনী অগ্রণীর ভূমিকা নিয়ে গান্ধীজি ও অন্য নেতাদের সঙ্গে কারাবরণ করেন। ’৪২-এর আন্দোলনেও সরোজিনী সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। প্রায় ২১ মাস কারারুদ্ধ ছিলেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তদানীন্তন ইউনাইটেড প্রভিন্স অব আগরা অ্যান্ড অওয়ধ অধুনা উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল হন। ১৯৪৯-এ তাঁর জীবনাবসান হয়।
সরোজিনী নাইডু ছিলেন প্রগতিশীল, আধুনিকমনস্কা। এক দিকে সংকল্পে অটল, অন্য দিকে প্রকৃতিপ্রেমী ও কল্পনাপ্রবণ। তাঁর ভাবাবেগ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার প্রতিটি ছত্রে। যথার্থই তিনি ছিলেন ‘দ্য নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’।
আরও পড়তে পারেন
মাত্র ১৭ বছর বয়সে ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ দিয়ে শহিদ হন কনকলতা বরুয়া
প্রবল সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রানি রাসমণি বার বার লড়েছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে
গোয়ালিয়রের ফুলবাগ এলাকায় ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে শহিদ হন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ