রাজনীতিতে আসা আর ছাপ ফেলে যাওয়া এক নয়। বিশেষত, স্বাধীন ভারতে জাতীয় রাজনীতিতে যাঁরা নিজেদের নাম উজ্জ্বল করেছেন, তাঁদের লড়াইয়ের পথ বেশ দীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল। ঠিক যেমন, ভারতীয় জনতা পার্টির (BJP) অভিজ্ঞ নেত্রী, প্রয়াত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ (Sushma Swaraj)।
আদালত চত্বর থেকে রাজনীতির ময়দানে

সুষমার জন্ম অধুনা হরিয়ানার আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে ১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। বাবা হরদেব শর্মা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সুষমার বাবা-মা লাহোরের বাসিন্দা ছিলেন। সুষমা আম্বালা ক্যান্টনমেন্টের সনাতন ধর্ম কলেজ থেকে স্নাতক হন এবং চণ্ডীগড়ের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসাবে প্র্যাকটিস শুরু করেন।
সত্তরের দশকে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সদস্য হিসাবে সুষমার রাজনৈতিক জীবন শুরু। তাঁর স্বামী স্বরাজ কৌশল সমাজবাদী নেতা জর্জ ফার্নান্ডেজের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সুষমাও ১৯৭৫ সালে ফার্নান্ডেজের লিগ্যাল ডিফেন্স টিমের সঙ্গে যুক্ত হন। সেই সময় জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষিত জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জরুরি অবস্থা শেষ হওয়ার পর সুষমা ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দেন।
২৫ বছর বয়সেই বিধানসভায়

২৫ বছর বয়সে আম্বালা ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্র থেকে জিতে সুষমা ১৯৭৭-এ হরিয়ানা বিধানসভার সদস্য হন। প্রথম দফায় তিনি ১৯৮২ পর্যন্ত বিধায়ক ছিলেন। সেই সময় দেবী লালের নেতৃত্বাধীন জনতা দল সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন। ১৯২৯-এ তিনি হরিয়ানায় জনতা দলের রাজ্য সভাপতি হন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত হরিয়ানায় বিজেপি-লোকদল জোট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন সুষমা স্বরাজ। সংসদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি নিয়ে ১৯৯৮-এর অক্টোবরে দিল্লির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীও হন।
সংসদে প্রবেশ এবং মন্ত্রিত্ব

১৯৯০-এর এপ্রিলে সুষমা স্বরাজ রাজ্যসভার সদস্য হন। ওই পদে তিনি ছিলেন ১৯৯৬ পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ দিল্লি লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রীসভার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হন। বাজপেয়ীর সেই সরকার অবশ্য মাত্র ১৩ দিন টিকেছিল। ১৯৯৮-এর মার্চে ফের লোকসভা নির্বাচন হলে সুষমা দক্ষিণ দিল্লি কেন্দ্র থেকে আবার নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয় বাজপেয়ী মন্ত্রীসভার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হন। তার সঙ্গে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। তবে এই পদে তিনি বেশি দিন ছিলেন না। দলের নির্দেশে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে সুষমা ১৯৯৮-এর অক্টোবরে দিল্লির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হন। তবে তাঁর দল বিধানসভা নির্বাচনে পরাস্ত হলে সুষমা তাঁর জেতা বিধানসভা আসন থেকে ইস্তফা দেন ও জাতীয় রাজনীতিতে ফিরে আসেন।
সনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রার্থী

১৯৯৯-এর সেপ্টেম্বরে ত্রয়োদশ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সুষমাকে কর্নাটকের বল্লারি কেন্দ্র থেকে সনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রার্থী করে। সেই নির্বাচনে অবশ্য তিনি হেরে যান।
দায়িত্ব একাধিক মন্ত্রকের

সুষমা আবার সংসদে ফিরে আসেন ২০০০-এর এপ্রিলে উত্তরপ্রদেশ থেকে রাজ্যসভার সদস্য হয়ে। ওই বছরেরই সেপ্টেম্বরে তিনি অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় ফের ফিরে আসেন, আবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়ে। ওই পদে তিনি ২০০৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত ছিলেন। এর পর তিনি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণ ও সংসদ বিষয়ক দফতরের মন্ত্রী হন। ওই পদে ছিলেন ২০০৪-এর মে পর্যন্ত। ওই বছর বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট লোকসভা নির্বাচনে পরাস্ত হয়।
২০০৬-এর এপ্রিলে সুষমা ফের রাজ্যসভায় ফিরে আসেন, এ বার মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা থেকে জিতে। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মধ্যপ্রদেশের বিদিশা কেন্দ্র থেকে জিতে সুষমা লোকসভায় বিরোধীদলের নেতা হন।
২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রীসভায় তিনি বিদেশমন্ত্রী হন। ইন্দিরা গান্ধীর পর সুষমাই দ্বিতীয় মহিলা যিনি বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। পুরো পাঁচ বছর মন্ত্রী থাকার পর অসুস্থতার জন্য তিনি গত মে মাসের লোকসভা নির্বাচনে লড়েননি। ভারতের ইতিহাসে সুষমাই সব চেয়ে কম বয়সে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি ওই পদ লাভ করেন।
ভালোবাসার রাজনীতিবিদ

২০১৫-এর নেপাল ভূমিকম্পে নাগরিকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ভারত যে ভাবে নেপালকে সাহায্য করেছিল তার স্বীকৃতিস্বরূপ স্পেনের সরকার ২০১৯-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি সুষমা স্বরাজকে ‘গ্র্যান্ড ক্রস অব অর্ডার অব সিভিল মেরিট’ সম্মানে ভূষিত করে। মার্কিন পত্রিকা ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ সুষমা স্বরাজকে ভারতের ‘সব চেয়ে ভালোবাসার রাজনীতিবিদ’ (বেস্ট-লাভড্ পলিটিশিয়ান) হিসাবে নির্বাচিত করেছিল। ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর অবদান মনে রাখার মতোই।
আরও পড়তে পারেন:
প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত, যার রেশ অব্যাহত এখনও