জল নেই, কাপসার ছেলেরা আইবুড়োই থেকে যায় : জলছবি/৬

0

খবর অনলাইন : মাথার ওপর সূর্য, যেন দ্বিগুণ প্রতাপ নিয়ে জ্বলছে। পায়ের তোলায় ধুলোভরা ভাঙাচোরা পাথুরে পথ। কাঁখে প্লাসটিকের জলপাত্র। ভুরি চলেছেন বিড়বিড় করতে করতে।

নিজের ভাগ্যকেই দুষছিলেন প্রৌঢ়া। বাবা-মা এমন একটা জায়গায় বিয়ে দিলেন যে সারা জীবন এই জল টানতে টানতেই কেটে গেল। আগে জানতে পারেননি কোথায় বিয়ে হচ্ছে। জানতে পারলে এই গ্রামে কেউ বিয়ে করে ? কোনও মেয়ে সারাটা জীবন এই ভাবে কাটাতে চায় ? বছরে ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা এই ভাবে জল টানা! তা-ও এক-আধ বার নয়, দিনে বেশ কয়েক বার।

ওই যে পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে, গ্রাম থেকে দু’ কিমি দূরে। পাহাড়ের মাথায় আছে ‘পাহাড়ওয়ালি মাতা কা মন্দির’। আর পাহাড়তলিতে রয়েছে পানীয় জলের প্রাকৃতিক উৎস। ভরা গরমেও যার জল শুকোয় না। কাপসা গ্রামে এই একটিই পানীয় জলের উৎস। তাই দিনে বারকয়েক এখানে আসতে হয়। যা-ই হোক, এই অজুহাতে মায়ের তো দর্শন মেলে। একই সঙ্গে রথ দেখা আর কলা বেচা, দুই-ই হয়। জলের সংকট না থাকলে হয়তো কাপসা গ্রাম পাহাড়ি মাকে ভুলেই থাকত। দূর থেকে মায়ের উদ্দেশে দু’ হাত কপালে ঠেকায় ভুরি।

তাঁর তো ভাগ্য মন্দ, কিন্তু তাঁর ছেলেদের ? আসলে ছেলেদের ভাগ্য তো মায়ের সঙ্গেই জুড়ে থাকে।

যে কারণে ভুরি নিজেকে দুষছিলেন, ঠিক সে কারণেই তাঁর তিন বিবাহযোগ্য সুপুত্রের ভাগ্যে জীবনসঙ্গিনী জুটছে না। একেই তো এখানে, এই ঠাকুর-যাদব-দলিত-পালদের গ্রামে জাত-বর্ণ-ধর্ম মিলিয়ে, ঠিকুজি-কোষ্ঠী বিচার করে পাত্রী পাওয়া মুশকিল, তার ওপর দেনা-পাওনার ব্যাপার আছে। কিন্তু এ সব তো দূরের কথা। পাত্রীপক্ষ যেই শুনছে বিয়ের পর নিয়মিত পানীয় জল টেনে আনতে হবে ২ কিমি দূরের পাহাড়তলি থেকে, তখনই পিছিয়ে যাচ্ছে তারা।

এ তো শুধু ভুরির একার সমস্যা নয়, কাপসার ঘরে ঘরে বিয়ের জুগ্যি ছেলেরা বসে আছে। একই রকম চিন্তার চিহ্ন রণবিজয় সিংহের চোখেমুখে – “মেয়েদের বাবারা আমাকে জিগগেস করেন, ‘আপনি বা আপনার ছেলেরা যখন গ্রামে থাকবে না, তখন আমার মেয়ে কী ভাবে সংসার সামলাবে ? এই ভাবে কি সারা জীবন জল বয়ে বয়ে আনবে ?’ আমি কোনও উত্তর দিতে পারি না।” রণবিজয়েরও দু’টি ছেলের বিয়ে দিলেই হয়। কথাবার্তা চলে, কিন্তু ওই একটা ব্যাপারে সব বিগড়ে যায়। “পাত্রীপক্ষ থেকে বেশ কয়েক বার আমার দুই ছেলেকে দেখত এসেছে। আমি বাবা হয়ে কী আর বলব ? ছেলেরা আমার দেখতে বেশ ভালো, লম্বা। রোজগারপাতি ভালো। মেয়ের পরিবারের পছন্দ হল। তার পর যেই তারা গ্রামে জলসমস্যার কথা জেনে গেল, আর যোগাযোগ করে না” – আক্ষেপ ঝরে পড়ল রণবিজয়ের গলায়।

অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ২০১২ সালে বড়ো ছেলে ভরতের বিয়ে দিতে পেরেছেন রণবিজয়। কিন্তু ছোট দুই ছেলের বিয়ে কিছুতেই দিতে পারছেন না। এ যেন পাহাড় নড়ানোর সামিল। তিন ছেলেই বাইরে থাকেন। গুজরাতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেন।

উত্তরপ্রদেশের ৫০টি জেলা খরায় ভুগছে। এর মধ্যে কাপসার অবস্থা খুবই খারাপ। এমনিতেই কাপসায় জলের কষ্ট বরাবর। এর ওপর পর পর কয়েক বছরের খরায় এ বার সংকট চরমে। গ্রামে কোনও টিউবওয়েল নেই, কাছাকাছি কোনও ক্যানেল নেই। গোটা পাঁচেক পুকুর, সব শুকিয়ে কাঠ। ২০টা হ্যান্ডপাম্প আছে, তার মধ্যে ৭টি চলে। কিন্তু এগুলো থেকে এত নোনাজল ওঠে যে তা পানের অযোগ্য। মাঝেসাঝে দু-একটি ট্যাংকার আসে জল নিয়ে। নিমেষে শেষ হয়ে যায়। তাই একমাত্র স্থায়ী ভরসা পাহাড়তলির জল। রোজ জল আনো আর ‘পাহাড়ওয়ালি মাতা কা মন্দির’-এ পায়ের ধুলো দাও। এই হল এখানকার মেয়েদের দৈনিক রুটিন।

স্বাভাবিক নিয়মেই গ্রামের মেয়েদের অন্য গ্রামে বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু বাইরের কোনও পরিবার তাদের মেয়েকে হামিরপুর জেলার মৌদহ তহশিলের এই গ্রামে বউ করে পাঠাতে চায় না। ভয়, পাছে ভুরির মতো অবস্থা হয় তাদের।

এই গ্রামের অধিবাসীদের প্রধান পেশাই হল চাষাবাদ করা। কিন্তু নিদারুণ খরায় কৃষিকাজ লাটে। আজ গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবার শক্তসমর্থ পুরুষ-শুন্য। সকলেই চলে গেছেন রুজির সন্ধানে শহরে। গ্রামে পড়ে আছেন বয়স্ক মানুষজন, কচিকাঁচারা আর ভুরির মতো দুর্ভাগা যাঁরা, ভালো করে খোঁজখবর না করে যাঁদের বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের পাঠিয়েছিল বউ করে।

ভুরির বয়স ৪৮। তিন দশক আগে তাঁর বাবা-মা যে ভুল করেছিলেন, এখন আর সেই ভুল করতে চান না বাইরের গ্রামগুলোর কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা-মায়েরা। ফলে জলসংকটের পাশাপাশি এক অদ্ভুত সামাজিক সংকটে ভোগে কাপসা।

সৌজন্যে : দ্য হিন্দু

dailyhunt

খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল

বিজ্ঞাপন