খবর অনলাইন: ২০০১ সালে খবর হয়েছিল রাজস্থানের জয়পুর জেলার দুদু ব্লকের গ্রাম লাপোরিয়া। এই লাপোরিয়াই জেলার একমাত্র গ্রাম যেখানে ট্যাংকারের সাহায্যে জল পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, অথচ এই জেলার বাকি সব গ্রামে জল পাঠাতে হয়েছিল। লাপোরিয়ার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে ২০১৬ সালের এই দুর্দান্ত গ্রীষ্মে।
রাজস্থানের বেশির ভাগ গ্রামে গেলে দেখা যাবে সরকারের পাঠানো জলের ট্যাংকারের সামনে দীর্ঘ লাইন। কিন্তু জয়পুর শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের লাপোরিয়া ব্যতিক্রম। এখানকার ৩৫০টি পরিবার খরা কী তা গত ৩০ বছর ধরে জানে না। আশেপাশের অঞ্চলে মাটির নীচে জল যেখানে ৫০০ ফুট গভীরে চলে গিয়েছে, সেখানে লাপোরিয়ায় ভূগর্ভের ১৫ থেকে ৪০ ফুট গভীরে গেলেই জল। গ্রামের প্রায় হাজার দুয়েক মানুষের জলের প্রয়োজন নিজেই মেটায় লাপোরিয়া। শুধু তা-ই নয়, আশেপাশের ১০-১৫টা গ্রামে জল পাঠায় লাপোরিয়া। কী ভাবে জলের প্রয়োজন মেটায় লাপোরিয়া ? কারণ সেখানকার মানুষ জানে বৃষ্টির জল থেকে কী ভাবে ফলন পেতে হয়।
জলের অভাব থেকে জলে স্বয়ম্ভরতা। লাপোরিয়ার এই যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৭৭ সালে। লক্ষ্মণ সিং তখন ১৮ বছরের। গ্রামে ফিরে এসে দেখল চারিদিকে চরম দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর জাতপাত নিয়ে মারামারি। স্কুলছুট লক্ষ্মণ বুঝতে পারল, দুর্ভাগ্যের এই কদর্য চক্রের যদি অবসান ঘটাতে হয়, তা হলে গ্রামকে কৃষিতে সমৃদ্ধশালী হতে হবে।
কিন্তু কৃষিতে সমৃদ্ধশালী হওয়া তো ভীষণ কঠিন। সব চেয়ে বড়ো বাধা জল। জলের নিদারুণ অভাব। “মাটির নীচে জল অনেক অনেক গভীরে। পাম্প করে সেই জল টেনে তোলার ক্ষমতা গ্রামের নেই। ঠিক করলাম আমরা যদি মাটির গভীরে না যেতে পারি, তা হলে জল-ই উপরে আসবে” – বলছিলেন লক্ষ্মণ। রাজস্থানে বৃষ্টির জল কাজে লাগানোর যে ট্র্যাডিশনাল প্রথা রয়েছে, মূলত তাকেই ভিত্তি করে চৌকা ব্যবস্থা তৈরি করলেন লক্ষ্মণ। গড়লেন অলাভজনক সংস্থা গ্রাম বিকাশ নবযুবক মণ্ডল লাপোরিয়া (জিভিএনএমএল)।
চৌকা ব্যবস্থা অনুযায়ী লাপোরিয়ার জমিতে ছোট ছোট, একে ওপরের সঙ্গে সংযুক্ত, ঢালযুক্ত ৯ ইঞ্চি গভীর চৌকো গর্ত বানানো হল। গর্তগুলোর ধারে মাটি দিয়ে বাঁধ দেওয়া হল। জল একটা চৌকায় জমা হলেই পাশের চৌকায় চলে যাবে, আবার তার পাশেরটায়। মাটির বাঁধ দিয়ে ঘিরে রাখার জন্য জল সব চৌকায় ছড়িয়ে পড়বে। তার পর চৌকা থেকে পুকুরে জমা হবে জল। এ ভাবেই বৃষ্টির জল জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা হল। বৃষ্টির জল জমিয়ে রাখার এই পদ্ধতি মাটির উপরের স্তর ভিজিয়ে মাটির নীচে যায়। এ ভাবেই ভূগর্ভস্থ জলের সঞ্চয় বাড়ে। আর ঘাস, ঝোপঝাড় গজায়।
এ ভাবেই লাপোরিয়ার ৪০০ বিঘা জমিতে বছরের পর বছর ধরে চৌকা গড়ে তোলা হয়েছে। বৃষ্টির জল ধরে রাখার এই ব্যবস্থা তৈরি করতে গ্রামবাসীরা এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা অর্থ দিয়েছেন, শ্রম দিয়েছেন। “রবি ফসলের জন্য মাটির নীচে থেকে এতটুকু জল তোলা হয়নি। উলটে ভূগর্ভে জল পাঠানো হয়েছে। মাটির নীচের সেই জল এখন এই গরমে চাষের কাজে লাগানো হচ্ছে” – বলছিলেন গ্রামের চাষি ছটু সিং।
তা ছাড়া চাষের প্রথাতেও বদল এনেছেন গ্রামবাসীরা। যে ফসলে জল বেশি লাগে সেই ফসল চাষ না করে এই গ্রীষ্মে সবুজ সবজি চাষ করা হচ্ছে এবং সেই সব জমিতেই চাষ করা হচ্ছে যা কুয়োর কাছে।
এই সুশৃঙ্খল জল ও চাষের ব্যবস্থা থেকে আরও ফসল তুলেছেন গ্রামবাসীরা। চাষের জমি এখন যে হেতু সব সময়েই সবুজ থাকে তাই গবাদি পশুরা নিজেদের জন্য যথেষ্ট খাদ্যশস্য পায়। গুজরাত থেকে ‘গির’ নামে এক ধরনের গরু এনে এখানে পশুপালন করা হচ্ছে। একটা গির গরু দৈনিক ৮-১০ লিটার দুধ দেয়। লাপোরিয়ার প্রতিটি পরিবারে অন্ততপক্ষে দু’টি করে গির গরু আছে। গরুর দুধ বিক্রি করে এই গ্রামের মানুষজন ভালোই রোজগার করছেন। লাপোরিয়ার এই দৃষ্টান্ত আশেপাশের বহু গ্রাম অনুসরণ করতে শুরু করেছে।
তা হলে জল যে কত অর্থকরী ফসল হতে পারে তা বোঝে লাপোরিয়ার গ্রামবাসীরা। তারা বোঝে, জলের মূল্য কোনও কিছু দিয়ে মাপা যায় না। জল অমূল্য। জলের সুফল পেতে হলে একে পুজো করতে হয়। তাই কুয়ো বা জলাশয় থেকে দিনের প্রথম মুহূর্তে যে জল তোলা হয়, তার সামান্য কিছুটা ঢালা হয় লাপোরিয়ার শিবের মাথায়।
সৌজন্যে: দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।