দীধিতি ঘোষ: “হ্যাঁ, তবে আরও তিন-চার দিন বাকি। ক’টা দিন গেলেই চার বছর পূর্ণ হবে। ২০১৩-এর ১ ফেব্রুয়ারি বেরিয়ে পড়েছিলাম বিশ্বভ্রমণে। ছোটোবেলা থেকেই সাইকেল বেড়ানোর খুব সাধ। তবে তখনকারটা ছিল মাপে ছোটো, গায়ে জোরও তেমন নেই। তাই বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে একটা ভালো সাইকেলের দরকার ছিল। সেটা জোগাড় হল। তার পর তো আর কথাই নেই – সোজা পৃথিবী ভ্রমণ।”
বছর ৩৭-এর ছিপছিপে চেহারার যুবক। নাম আয়ান কাসকান্তে বেখারানো। বাড়ি কোস্তা রিকায়। বইমেলায় আচমকাই এসে পড়েছেন। সাইকেলে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে নেপালে এসে খবর পান কলকাতায় আন্তর্জাতিক বইমেলা হচ্ছে, আর সেখানে ‘থিম কান্ট্রি’ হল তাঁরই দেশ। ব্যাস, দু’ চাকায় ভর করে সোজা কলকাতায়।
শুক্রবার বইমেলায় কোস্তা রিকার প্যাভিলিয়নে আয়ান শোনাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। আয়ানের অভিজ্ঞতার কথা আলাদা করেও জানার সৌভাগ্য হল। আয়ান বলছিলেন, “অনেকেই আমাকে ঘরসংসার নিয়ে প্রশ্ন করেন। কেউ বিশ্বাস করতে চান না যে আমার স্থায়ী সঙ্গী এক জনই, আমার সাইকেল। তবে আমি তো মানুষ, আমারও দরকার হয় ভাব বিনিময়ের, আমার মনের কথা প্রকাশ করার, তাই দিনের শেষে মায়ের সঙ্গে কথা হয় স্কাইপে।”
তা হঠাৎ কেন মনে হল সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ করবেন?
“আসলে ভ্রমণ আমার নেশা, আর বিশ্বভ্রমণ করা আমার বহু দিনের সাধ। ভ্রমণের বাহনের মাধ্যম হিসাবে সাইকেলটা বেছে নিলাম তিনটি কারণে। প্রথমত, এই জানে দূষণ নেই। দ্বিতীয়ত, একসারসাইজ-এর সুবর্ণ সুযোগ। আর তৃতীয়ত, পরিবহণের খরচ অনেক কম।” তাই কোনো ভাবেই চার চাকার সঙ্গে সাইকেলের তুলনা করতে চান না আয়ান।
উল্লেখযোগ্য, কোস্তা রিকা দেশটা বড়ো সবুজ। সেখানে কোনো রকম বায়ু দূষণ নেই। রয়েছে অনেক গাছপালা, জীবজন্তু, বিশ্বের অনেক দেশেই যা পাওয়া যায় না। এক কথায় জীববৈচিত্র্যে ভরপুর কোস্তা রিকা। আর সে কারণেই বোধহয় আয়ানের পছন্দের রঙ সবুজ।
এই বিশ্বের কতটা ঘোরা হল চার বছরে?
চটজলদি জবাব আয়ানের – এখনও পর্যন্ত ৮৩টি দেশ ঘুরেছেন – ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার বহু দেশ, তুরস্ক, আরব ইত্যাদি। ভারত তো আছেই। বহু জায়গা ঘোরা হয়ে গেল ভারতের। দক্ষিণের কোচি, কন্যাকুমারী, মাদুরাই, পশ্চিমের মুম্বই, গোয়া, রাজস্থান, উত্তরের জম্মু থেকে হৃষীকেশ। তার পর গেলেন নেপাল। সেখান থেকে বিহার হয়ে এই কলকাতায়। কলকাতায় এসে চন্দননগরও ঘুরে এসেছেন আয়ান।
এক দেশ থেকে আরেক দেশে কী করে যান, যদি ল্যান্ড বর্ডার না থাকে, বা ল্যান্ড বর্ডার দিয়ে পেরোনো সম্ভব না হয়?
আয়ান জানালেন, “বিমানে করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাই। বড়ো বড়ো পাহাড়-সমুদ্র তো আর সাইকেলে পেরোনো সম্ভব নয়। আমি দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই দেশ দেখব বলে, অ্যাডভেঞ্চার করার জন্য নয়। তবে হ্যাঁ, এক বার একটা দেশে পৌঁছে গেলে সেই দেশটা চষে বেড়াই সাইকেলে। কারণ সব কিছু চোখ ভরে দেখার সুবর্ণ সুযোগ দেয় সাইকেলই।”
কিন্তু খরচের ব্যাপারটা কী ভাবে মেটান?
একটু থেমে আয়ান বললেন, “টাকা রোজগার হয় ছোটোখাটো কাজ করে। কখনও ধাবায় রান্না করে, কখনও বা পত্রিকায় লিখে বা অনুবাদের কাজ করে। অনলাইনের মাধ্যমে অর্থ জোগাড় হয়।”
কথায় কথায় আয়ান জানালেন, তিনি এক জন ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ার। সরকারি কাজ করেছেন ১০ বছর। কিছু টাকা জমে। কাজ ছেড়ে দেন। ঠিক করেন, জমানো টাকায় পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়বেন।
বাবা-মা বাধা দেননি?
আয়ান বললেন, “পৃথিবী ভ্রমণের কথা শুনে বাবা-মা রাজি হননি। তবে বাধাও দেননি। আশীর্বাদ করেন, যেন নিজের ইচ্ছামতো জীবন গড়ি, জীবন সার্থক করি। সেই সময়টা আমার চিরকাল মনে থাকবে। একটা প্রাণবন্ত, অবিস্মরণীয় ছবি হিসাবে মনের মধ্যে জেগে থাকবে।”
এর পরের গন্তব্য কোথায়?
পরের গন্তব্য ব্যাংকক। তার পর সেখান থেকে হয়তো বা বাংলাদেশ। তবে কোনো কিছু আগেভাগে ঠিক করে রাখেন না আয়ান। বললেন, “জীবন হল ঢেউয়ের খেলা। কখন কী হয় কেউ বলতে পারে না। তাই যখন যে মুহূর্ত আমাদের কাছে আসে, আমাদের উচিত সে মুহূর্তগুলির সঙ্গে বন্ধুত্বে মাতা।”
বাড়ির খোঁজ নিচ্ছিলাম আয়ানের কাছে। জানালেন, বাড়িতে আছেন বাবা, মা আর বোন। তা হলে ওদের টানে বাড়ি ফিরতে মন চায় না? দ্বিধা না করে আয়ান বললেন, “কখনও তো নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরব। বাড়ি ফিরে সংসারে মনোনিবেশ করব। তবে এখনই ফিরছি না। অন্তত বছর চারেক তো নয়ই। এখন অনেকটা পথ চলা বাকি – নিজের জন্য, নিজের জীবন সার্থক করার জন্য।”
এ বারের কলকাতা বইমেলার ‘থিম কান্ট্রি’ কোস্তা রিকা। জানা ছিল না আয়ানের। বিদেশে এসে হঠাৎই পেয়ে গেলেন নিজের দেশকে। আয়ানের কথায়, “জীবন একটু অন্য রকম হলে, চলার পথে ঈশ্বর মাঝে মাঝে কিছু উপহারও দেন।”