শ্রয়ণ সেন
এক জুনিয়র ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছেন মধ্যবয়সি এক মহিলা।
অশীতিপর এক বৃদ্ধার রক্ত গরম করা কথায় উজ্জীবিত হয়ে উঠল গোটা ধর্নামঞ্চ।
স্লোগানে-গানে মুখরিত হয়ে উঠল গোটা ধর্নামঞ্চ। বোঝা গেল অসংখ্য সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে যোগ দিচ্ছেন এখানে।
সোমবার বিকেলে এই রকমই টুকরো টুকরো কিছু ছবি দেখলাম ধর্মতলার ধর্নামঞ্চে, যেখানে সিস্টেম পরিবর্তনের ডাক দিয়ে আমরণ অনশনে বসেছেন সাত জুনিয়র ডাক্তার। দেবীপক্ষ শুরু হয়েছে বেশ কয়েক দিন। কিন্তু প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে গিয়ে ঠাকুর দেখার তাগিদটাই এবার পাচ্ছি না কোনোভাবেই। যখনই পুজোয় শামিল হওয়ার কথা ভাবছি, তখনই আরজি কর কাণ্ড, জয়নগর কাণ্ড ইত্যাদি মাথায় চলে আসছে। আর চলে আসছে এই সব জুনিয়র ডাক্তারের কথা।
আমার বয়স তেত্রিশ। সুতরাং এরা সবাই আমার বন্ধুসম। আমার থেকে ছোটোও হতে পারে। তারা যেখানে একটা গোটা ব্যবস্থার পরিবর্তনের ডাক দিয়ে এক অসম লড়াইয়ে নেমেছে, না খেয়ে থাকার পণ নিয়েছে, সেখানে আমার পক্ষে উৎসবে থাকা তো সম্ভব হবে না।
ভুল বললাম, উৎসবেই তো আছি। এটা যে বিদ্রোহের উৎসব। গোটা ধর্নামঞ্চ জুড়ে নানা রকম অভিনব স্লোগান লিখে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে একটায় লেখা, “শোক নয়, দ্রোহ, উৎসবেও বিদ্রোহ!” রাস্তায় গ্রাফিতি করা হয়েছে। এরই মধ্যে একটা জায়গায় কয়েকটা চৌকিতে অনশনে রয়েছেন সাত জন জুনিয়র ডাক্তার। ধর্নামঞ্চে লাগিয়ে রাখা হয়েছে একটা ঘড়ি। তার ঠিক তলায় লিখে রাখা হচ্ছে অনশনের কত ঘণ্টা অতিক্রান্ত হল। পাশেই লেখা হচ্ছে অনশনরত সাতজনের স্বাস্থ্য রিপোর্ট। যেটা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে যত সময় এগোচ্ছে, স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে আন্দোলনকারীদের।
কিন্তু তাতেও কোনো শোকের পরিস্থিতি নেই। বরং সবাই উজ্জীবিত। ধর্নামঞ্চের ঠিক পাশেই মাটিতে প্লাস্টিক পেতে প্রতীকী অনশনে বসেছেন সিনিয়র ডাক্তাররা। তাঁদের ঘিরে রয়েছে প্রচুর সাধারণ মানুষ। একটা সমাজ পরিবর্তনের ডাক সবাইকে কাছে এনে দিয়েছে। কেউ কাউকে চেনে না, কারও সঙ্গে কারও আগাম কোনো পরিচিতিই নেই। কিন্তু সবার লক্ষ্য এক।
বছরের পর বছর ধরে ঘটে চলে অনেক অন্যায়, অনেক অবিচার আজ সবাইকে কাছে এনে দিয়েছে। ধর্নামঞ্চে যাঁরা আসছেন না, পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছেন, অথবা বাসে করে দেখতে দেখতে যাচ্ছেন, তাঁদের মুখচোখেও সমীহের চাপ স্পষ্ট।
ভাবতে অবাক লাগে চার বছর আগে একটা কঠিন পরিস্থিতিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে চিকিৎসকসমাজ এবং প্রশাসন কাজ করেছিলেন, আজ তারাই একে অপরের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে। অথচ এমন কিছু হতই না যদি হাসপাতালগুলিতে সুস্থ পরিবেশ থাকত, ‘হুমকি সংস্কৃতি’ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকত না এবং সর্বোপরি যে পুলিশের ওপরে আমরা সবসময় ভরসা করি, তাদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ না উঠত।
বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রশাসন নিজেদের গাফিলতির কারণেই আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আর তাই মানুষও জেগে উঠেছে। হয়তো ১৪ আগস্টের রাত দখলের সেই পরিস্থিতি এখন নেই। হয়তো বিশাল সংখ্যক মানুষ প্রতিবাদের রাস্তায় এখন নেই। কিন্তু এটা বুঝতে অসুবিধা নেই যে পুজোর মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে পুজোর পর কিন্তু এই বিদ্রোহ আরও বাড়বে।
যাই হোক, ধর্নামঞ্চের যেদিকে সিনিয়র ডাক্তাররা বসেছিলেন, সেখানেই শুরু হল স্লোগান দেওয়া। ‘উই ডিমান্ড জাস্টিস’-এর মতো পরিচিত স্লোগান দেওয়া শুরু হল। একটু একটু করে স্লোগানেও নানা রকম অভিনবত্ব এল। ‘জাস্টিস’-এর ‘ডিমান্ড’-এ আরজি করের সঙ্গেই জয়নগরকেও মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে সুন্দরভাবে। আরও নানা রকম স্লোগানের মধ্যে দিয়ে খেয়াল হল, আমিও তো স্লোগানে গলা মেলাতে শুরু করেছি।
আমার ব্যক্তিগত মতামত যা-ই হোক না কেন, প্রতিষ্ঠানবিরোধী স্লোগানে গলা মেলাতে কুণ্ঠাবোধ করতাম। না না কুণ্ঠা না, ভয় পেতাম। ভয়টা সংক্রমণের মতোই ছড়িয়েছিল। প্রতিষ্ঠানের একটু বিরোধিতা করলেই মাথার ওপরে খাঁড়া নেমে আসার ভয়। কিন্তু সাহসও যে সংক্রামক সেটা বুঝলাম এই ধর্নামঞ্চে এসেই। এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ুক সমাজের আরও গভীরে। তবেই আসবে প্রকৃত পরিবর্তন।