চুঁচুড়া: বনেদি পরিবারের পুজো বললেই কলকাতা মহানগরীর বনেদি পরিবারগুলির কথাই আমাদের প্রথম মনে পড়ে। কিন্তু এই মহানগরের বাইরেও বহু বনেদি পরিবার রয়েছে যেখানে বহু বছর ধরে দেবী দুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে। তেমনই এক বনেদিবাড়ি হল চুঁচুড়ার মণ্ডল পরিবার।
পারিবারিক ইতিহাস জানা গেল মণ্ডল পরিবারের সদস্য কৌশিক দেবমণ্ডলের কাছে। কৌশিকবাবুর কথা অনুযায়ী, এই বংশের পূর্বপুরুষদের আদি বাসস্থান ছিল সাতগাছিয়া অঞ্চলে। সময়টা ছিল আনুমানিক ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ। তখন এই পরিবারের পদবি ছিল ‘দে’ এবং তারা তুলোর ব্যবসা করত। পরে এই ‘দে’ পদবিটি ‘দেব’-এ রূপান্তরিত হয়। তার পর এই পরিবারের সদস্যরা ওড়িশার বালেশ্বর অঞ্চলে চলে যান এবং সেখানে নুনের ব্যবসা শুরু করেন। এই বালেশ্বর অঞ্চলের জমিদারি তাঁরা পেয়েছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে এবং পেয়েছিলেন ‘মোড়ল’ উপাধি। সেই ‘মোড়ল’ই পরবর্তী কালে ‘মণ্ডল’-এ রূপান্তরিত হয়। ‘দেব’ এবং ‘মণ্ডল’ মিলিয়ে পরিবারের সদস্যরা ‘দেবমণ্ডল’ হিসাবে পরিচিত হন। ওড়িশার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁদের জমিদারি ছিল।
বেশ কিছু বছর ওড়িশায় থাকার পর মণ্ডলদের একটা অংশ চলে আসে চুঁচুড়ায় আনুমানিক ১৮৩০ সাল নাগাদ। তখন চুঁচুড়া ছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে। সেই সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ডাচ কোম্পানির বিরোধ বাধে। ডাচ কোম্পানি চুঁচুড়া অঞ্চল ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। চুঁচুড়ায় থাকাকালীন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি ভিলা তৈরি করেছিল। মণ্ডল পরিবারের সদস্যরা ওই ভিলাটি ডাচ কোম্পানির কাছ থেকে কিনে নেন। স্বর্ণবণিক সম্প্রদায়ভুক্ত এই মণ্ডল পরিবার বঙ্গে এসেও নুনের ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত থাকে।

চুঁচুড়ায় বসতি নির্মাণের পর মণ্ডল পরিবারের সদস্যরা দুর্গাপুজো করার সিদ্ধান্ত করেন। মণ্ডলরা ১৮৩০ সাল নাগাদ চুঁচুড়ায় বসতি স্থাপন করেন। এবং তার কয়েক বছর পরে তাঁরা দুর্গাপূজা শুরু করেন। এই পরিবারে একটি পুরোনো কাঠামো রয়েছে। সেই কাঠামোতেই ঠাকুর তৈরি হয় প্রতি বছর। পরিবারের সদস্যদের কথানুযায়ী কাঠামোটি ১৮০ বছরের পুরোনো। তাই ধরে নেওয়া যায়, চুঁচুড়ার মণ্ডল পরিবারে শিবদুর্গার আরাধনা অত্যন্ত ১৮০ বছর ধরে চলে আসছে।
এ ছাড়া মণ্ডলবাড়িতে একটি বিশেষ পট রয়েছে। সেই পট অনুযায়ী চালচিত্র আঁকা হয়। সেটি এই পরিবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই পরিবারে মা মহাদেবকে সঙ্গে নিয়ে আসেন অর্থাৎ সপরিবার দেবী মহাদেবের পাশে অধিষ্ঠান করেন। মহানবমীর দিন নবগ্রহের হোমযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় এই পরিবারে।
মণ্ডল পরিবারের কুলদেবতা হলেন শ্রীশ্রীরঘুনাথ জীউ। তিনি এখনও ওড়িশাতেই পূজিত হন। তাই এই পরিবারের দুর্গাপুজো সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে হয়ে থাকে।

এই পরিবারের আরও এক সদস্য অরূপ মণ্ডলের কাছে জানা গেল, তাঁদের শিবদুর্গাকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয় না। চালকুমড়ো বলিদান হয় এবং চালের নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়। সঙ্গে থাকে নানান রকমের তরিতরকারি, তেল, নুন ইত্যাদি।
এই পরিবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন দেবীর চক্ষুদানের সময় একটি বলিদান হয় এবং আরও একটি বলিদান হয় মহাষ্টমীর পুজোতে। রাত্রে দেবীকে নুন ছাড়া লুচিভোগ, বিভিন্ন রকমের ভাজা, মিষ্টান্ন ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।
অতীতে মহালয়ার দিন দেবীর বোধন হত। কিন্তু কালক্রমে সেই বোধন এখন হয় ষষ্ঠীর দিন। সন্ধিপূজায় ১০৮ দীপ জ্বালানো হয় এবং ১০৮ পদ্ম নিবেদন করা হয়। দশমীর দিন দেবীর বরণের পর কনকাঞ্জলি প্রথা পালন করা হয়। এ ভাবেই আজও প্রাচীন প্রথা মেনেই পুজো পেয়ে আসছেন মণ্ডলবাড়ির শিবদুর্গা।
আরও পড়তে পারেন
কামারপুকুরের লাহাবাড়ির দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ
সিঙ্গি গ্রামের ভট্টাচার্য বংশের ৩৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো ‘মঠের বাড়ির দুর্গোৎসব’
হুগলির জোলকুলের ভট্টাচার্য পরিবারের দুর্গাপুজোর এ বার ২১৭ বছর
দু’ দিন পরেই বোধন, সাবর্ণদের আটচালাবাড়িতে শুরু হয়ে যাবে ৪১২তম বছরের দুর্গাপুজো
রাজা নবকৃষ্ণ দেবের নির্দেশেই ১৭৫৭-য় শুরু হয়েছিল কলকাতার সব চেয়ে জাঁকজমকের পুজো
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।