মৃণাল মাহাত
তিনি চোখের সামনে দেখেছেন কী ভাবে জঙ্গলমহল থেকে শাল, মহুয়া, কেঁদ, বহেড়া শেষ হয়ে যাচ্ছে। দেখেছেন জঙ্গল ছোটো হতে হতে চাষজমিতে পরিণত হচ্ছে ডুংরি। স্বাভাবিক বাসস্থানের সংকুলানে অবলুপ্ত হচ্ছে পরিচিত পশু ও পক্ষীকুল। আরণ্যক পরিবেশের এই করুণ অবস্থায় বারবার মন কাঁদত তাঁর। অরণ্য রক্ষার একটা তাগিদ অনুভব করতেন মন থেকে। সেই তাড়না থেকেই বেলপাহাড়ির অতীত আরণ্যক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছেন ‘ফরেস্ট ম্যান অব বেলপাহাড়ি’ মনোরঞ্জন মাহাত, যিনি দীর্ঘ তিন দশক ‘হপন মাঝি’ নামে সাংবাদিকতা করায় জঙ্গলমহলে হপন মাঝি নামেই অত্যধিক পরিচিত।
বর্তমানে সমস্ত কাজ ছেড়ে বেলপাহাড়িকে সবুজ করার অভিযানে নেমেছেন হপনবাবু।
কেন এই ব্রত? হপন বাবু বলেন, “পেশা ও নেশার কারণে এই বেলপাহাড়ির প্রতিটি গ্রাম আমি চিনি এবং নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে গ্রামগুলোয়। আগে দেখেছি কত সবুজ ছিল, কত পশুপাখি ছিল, আর এখন ?”
হপনবাবু তাঁর নিজস্ব অনুসন্ধান থেকে দেখেছেন, তারাফেনী নদীর উৎসমুখ লালজল পাহাড়ের ঝরনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে গাড়রাসিনী পাহাড়ের কাছে কাঠচাঁড়া গ্রামের নদীর উৎসমুখ৷ কোটচুয়া পাহাড় থেকে ক্রমাগত পাথর চুরি হয়ে যাওয়ার ফলে মাটি ধসে ধসে ডুলিং নদীর উৎসমুখ একশো শতাংশ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে বর্ষার সময়টুকু বাদ দিলে নদীগুলিতে জল থাকে না বললেই চলে। এই ঘটনাই হপনবাবুকে ব্যথিত করে।
তিনি বলেন, “আমি দেখেছি প্রতিটি উৎসমুখের গাছ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘদিন ছায়া না থাকায় অতিরিক্ত রোদে উৎসমুখের ঝরনাগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই আমাদের প্রথম কাজ হল বনসৃজনের মাধ্যমে ঝরনার মুখগুলি খুলে দেওয়া।”

আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি পাঁশকুড়া বনমালী কলেজের এই স্নাতক বর্তমানে বেলপাহাড়িকে সবুজ করার কাজ ও পরিকল্পনা করতেই ব্যাস্ত। তিনি জানান, তাঁর এই পরিকল্পনা বহু দিন আগে থেকেই ছিল। কিন্তু পেশাগত কারণে এ দিকে সময় দিতে পারেননি সে ভাবে। বর্তমানে তাঁর মেয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত। অর্থের চিন্তা আর সে ভাবে নেই। সামাজিক কাজে তাই একশো শতাংশ সময় দিতে পারছি পারছেন।
হপনবাবুর এই মহৎ কাজের অংশীদার তাঁর অধ্যাপিকা মেয়ে। তিনিই প্রথম গাছ কিনে কাজ করতে সহযোগিতা করেন। সবুজের অভিযানে বেলপাহাড়ি অঞ্চলে নানা কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে।
গত বিশ্ব আদিবাসী দিবসে বেলপাহাড়ি চক্রের ৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫০০টি চারা রোপণ করা হয়েছে। এই মহৎ কাজে এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খুবই সহযোগিতা করেছেন বলে হপনবাবু জানান।
সম্প্রতি পুরাতাত্ত্বিক পর্যটনস্থল লালজল গুহা ও পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় ১৬০০ সিডবল ছড়ানো হয়। ১১০০-এরও বেশি ফলের চারা গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
সামাজিক মাধ্যম মারফত খবর পেয়ে আরও বহু মানুষই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সাহায্য দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রথম থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম কোনো রকম আর্থিক সাহায্য নেওয়া হবে না। অর্থের পরিবর্তে চারাগাছ বা বীজ দিলে সানন্দে তা গৃহীত হবে।”

প্রকৃতিপ্রেমী বহু মানুষ চারাগাছ ও বীজ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন বেলপাহাড়িতে। কলকাতা থেকে ‘নেচার ফরেস্ট’-এর ডাঃ মুনমুন কীর্তনিয়া ১৫০০ চারাগাছ পাঠিয়েছিলেন, পুরুলিয়া থেকে সাধন মাহাত নিয়ে এসেছিলেন ৩০০টি পলাশচারা। প্রভাত ঘোষ, ঝরনা আচার্য, ভূপেন মাহাত, এডিএফও পুরবী মাহাতো, মেদিনীপুর ছাত্র সমাজের মতো বহু ব্যাক্তি ও সংস্থা বেলপাহাড়িকে সবুজ করার অভিযানে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বলে তিনি জানান।
সম্প্রতি বেলপাহাড়ির অদূরে গজডুংরি নামে একটি ন্যাড়া পাহাড়ে বৃক্ষরোপণ করা হয়। পাহাড়ের পাদদেশে লাগানো হয় পলাশ, মহুয়া, কুসুম, শালের মতো জঙ্গলমহলের অতি পরিচিত গাছগুলি।
বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও লেখক প্রভাত ঘোষ লেখেন, “এই সময়ের অন্ধকারে আলোর পথ দেখাতে হাল ধরেছেন হপন মাঝি ওরফে মনোরঞ্জন মাহাত।” ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও কবি নিখিল মাইতি তাঁর ফেসবুক পোস্টে লেখেন, “সাংবাদিক প্রাবন্ধিক প্রকৃতিপ্রেমী এই মানুষটি বেলপাহাড়ি এলাকার হারিয়ে যাওয়া প্রকৃতি পুনরুদ্ধারে ব্রতী হয়েছেন ,আসুন আমরা সবাই এই উদ্যোগে শামিল হই।”
আরও পড়ুন: বুলবুলের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে মানবসভ্যতাকে ফের একবার বাঁচাল সুন্দরবন
সবুজের এই অভিযান আমৃত্যু চলবে বলে জানান ‘ফরেস্ট ম্যান অফ বেলপাহাড়ি’। অবলুপ্ত অরণ্য ও ঝরনার পুনরায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করাই তাঁর লক্ষ্য।