জুনের শেষেও পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। অস্বাভাবিক হারে কম বৃষ্টি হওয়ায় দক্ষিণবঙ্গে তখন এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। গত বছর এই দক্ষিণবঙ্গই বন্যার মুখোমুখি হলেও আগস্টের পরে সে ভাবে বৃষ্টি হয়নি। আর এ বারও যখন জুনে বর্ষা ৩১ শতাংশ ঘাটতি নিয়ে শেষ করল তখন খরা ঘোষণা করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।
জুন পেরিয়ে জুলাই এল। ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করল বর্ষার পরিস্থিতি। পশ্চিমবঙ্গ উপকূল লাগোয়া বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হতে থাকল একের পর এক নিম্নচাপ। যদিও এই নিম্নচাপগুলি সে ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে যাওয়ার ফলে বৃষ্টি বাড়ল এই অঞ্চলে। জুলাই যখন শেষ হল দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে। জুলাইতে যা বৃষ্টি হওয়ার কথা তার থেকে ৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণবঙ্গে। তবে কলকাতা শহরের বৃষ্টির পরিস্থিতি তখনও বেশ খারাপ। এতটাই খারাপ ছিল সে পরিস্থিতি যে জুলাইয়ের ২৪ তারিখ পর্যন্ত কলকাতার স্বাভাবিকের থেকে প্রায় আড়াইশো মিলিমিটার কম বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ২৫ ও ২৬ জুলাই, এই দু’দিনে ভালো বৃষ্টি হওয়ায় কলকাতার বৃষ্টি দুর্ভাগ্য কিছুটা পালটাল। কিন্তু তাও ঘাটতি রয়েই গিয়েছিল কলকাতার জন্য।
আগস্ট মাস সম্পূর্ণ নতুন রূপে হাজির হল দক্ষিণবঙ্গের জন্য। গত বছর এই আগস্ট থেকেই বৃষ্টি কমে গিয়েছিল দক্ষিণবঙ্গে, এ বছর সেই আগস্ট থেকেই বেড়ে গেল বৃষ্টির তেজ। এর নেপথ্যে পর পর তিন সপ্তাহে তিনটে নিম্নচাপ, যার মধ্যে দু’টি আবার প্রায় ঘূর্ণিঝড়ের কাছাকাছি নিজেদের শক্তিশালী করে ফেলেছিল। আর এই তিনটে নিম্নচাপ তিন দিক দিয়ে দক্ষিণবঙ্গে ঢোকার ফলে সব জেলাতেই বৃষ্টি হয়েছে মোটের ওপর সমান সমান।
এই তিনটে নিম্নচাপের মধ্যে প্রথমটি তৈরি হয় ৯ই আগস্ট। অবশ্য তার এক দিন আগেই মরসুমের প্রথম আকাশভাঙা বৃষ্টির কবলে পড়ে কলকাতা। সে দিন কোথাও কোথাও বৃষ্টির পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে এক ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটারের ওপর বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। ওই নিম্নচাপটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে উত্তর ২৪ পরগণা আর নদিয়া দিয়ে দক্ষিণবঙ্গে প্রবেশ করে। এর ফলে বিপুল বৃষ্টি হয় নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। ভালো বৃষ্টি হয় লাগোয়া বীরভূম, বর্ধমান জেলায়ও। তবে ওই নিম্নচাপটি পূর্ব-পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি জেলা এড়িয়ে গেলেও, এর পরের নিম্নচাপটির সরাসরি প্রভাব পড়ে ওই সব এলাকাতেই। দ্বিতীয় নিম্নচাপটির প্রভাবে জোর বৃষ্টির সাথে তীব্র ঝড় হয় কলকাতায় যার তাণ্ডবে ৬ জনের মৃত্যু হয় শহরে।

সর্বশেষ এল এখনকার এই নিম্নচাপটি। আগের দু’টি নিম্নচাপের মতো এই নিম্নচাপটি শক্তিবৃদ্ধি না করলেও, সব থেকে বেশি বৃষ্টি নামাল কিন্তু এটাই। রাঢ়বঙ্গ পুরো ভাসিয়ে দিয়েছে এই নিম্নচাপ। বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম, হুগলির বেশির ভাগ অঞ্চলেই দেড়শো মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে এই নিম্নচাপের ফলে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় আড়াইশো মিলিমিটার কম বৃষ্টি হওয়া কলকাতায় এখন প্রায় ৬০ মিলিমিটারের মতো বাড়তি বৃষ্টি। আগস্টে কলকাতায় যা বৃষ্টি হওয়ার কথা, মাসের প্রথম ২২ দিনেই তার থেকে ৩০ মিলিমিটার বেশি বৃষ্টি হয়েছে। শুধু কলকাতাই নয় দক্ষিণবঙ্গের বাকি সব জায়গাতেই বৃষ্টি এখন বাড়তি। এই মরসুমে এখনও পর্যন্ত বাঁকুড়ায় বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের থেকে ১৮০ মিলিমিটার বেশি, বর্ধমানে হয়েছে ৮৫ মিলিমিটার বেশি, দিঘায় হয়েছে ৬০ মিলিমিটার বেশি, ডায়মন্ড হারবারে হয়েছে ৩৭০ মিলিমিটার বেশি, মেদিনীপুরে হয়েছে ২০০ মিলিমিটার বেশি। এর ফলে পয়লা জুন থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা এখন ১২ শতাংশ বাড়তি।
তবে বন্যার ভ্রূকুটির মধ্যে থাকা দক্ষিণবঙ্গের জন্য একটি সুখবর রয়েছে। এই নিম্নচাপটি গতি বাড়িয়ে ফেলায় ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টির দাপট ক্রমশ কমে আসবে। সোমবার দুপুর থেকে দক্ষিণবঙ্গের আবহাওয়ার উন্নতি যেমন হয়েছে, মঙ্গলবার সকাল থেকে আবহাওয়ার উন্নতি ঘটবে ঝাড়খণ্ডেও। বৃষ্টির তেজ যত কমবে, জলাধার থেকে জল ছাড়ার পরিমাণও কমবে। এর ফলে কমবে বন্যার আশঙ্কা।
এই নিম্নচাপটি বিদায় নেওয়ার পর আগামী অন্তত এক সপ্তাহ সে ভাবে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা নেই দক্ষিণবঙ্গে। উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে এই মুহূর্তে আপাতত আর কোনও নিম্নচাপ তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছে না আবহাওয়া দফতর। বিদেশি কিছু আবহাওয়া সংস্থাও জানাচ্ছে, আগস্টের শেষের ক’টা দিন সে ভাবে ভারী বৃষ্টি হবে না দক্ষিণবঙ্গে। তবে বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টি চলবে। তবে এ বছর সেপ্টেম্বরেও যে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টির কবলে পড়তে পারে দক্ষিণবঙ্গ, সেটা জানাতে ভোলেনি সরকারি, বেসরকারি সব আবহাওয়া সংস্থাই। সারা দেশে স্বাভাবিকের থেকে ৭ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস করেছে আবহাওয়া দফতর। এর প্রভাব যে দক্ষিণবঙ্গেও পড়বে তা এখনই বলে দেওয়া যায়।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।