কাল শান্তিপুরে শ্রীরাধারমণের জামাইষষ্ঠী, পিছিয়ে নেই চাঁদুনীবাড়িও

0
শ্রীরাধারমণ জিউ ও শ্রীমতী।

শুভদীপ রায় চৌধুরী

আজ বাদে কাল জামাইষষ্ঠী। হিন্দু বাঙালিদের এক পারিবারিক মহোৎসব বলা যেতে পারে। সাধের জামাইকে আদরে-যত্নে ভরিয়ে দেবেন শাশুড়ি-মা। জামাইষষ্ঠীর দিন সকাল থেকেই সবাই তটস্থ, জামাই-আদরে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে। আর এই জামাই-আদর থেকে বাদ পড়েন না শান্তিপুরের বড়ো গোস্বামী বাড়ির রাধারমণও।

জামাইষষ্ঠীর দিন বড়ো গোস্বামী বাড়িতে সারা দিন ধরে চলে উৎসব, যে উৎসবের মধ্যমণি রাধারমণ। তবে শান্তিপুরে শুধু বড়ো গোস্বামী বাড়িতেই নয়, ধুমধাম করে জামাইষষ্ঠীর উৎসব পালিত হয় চাঁদুনীবাড়ির মুখোপাধ্যায়রাও।

জামাইষষ্ঠীতে রাধারমণ জিউ   

শান্তিপুরের ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের কথা এলেই যাঁদের নাম সবার প্রথমে উচ্চারিত হয় তাঁরা হলেন বড়ো গোস্বামীদের বংশধররা। এই বাড়ির ইতিহাস বহু দিনের। শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর বড়োপুত্র রাঘবেন্দ্র গোস্বামীর সময় থেকেই সূচনা এই বাড়ির। অদ্বৈতাচার্যের সেবিত নারায়ণশিলা আজও নিষ্ঠার সঙ্গে সেবা করা হয় বড়ো গোস্বামী বাড়িতে।

এই বাড়ির প্রধান দেবতা হলেন শ্রীরাধারমণ জিউ ও শ্রীমতী। রাধারমণ কষ্টিপাথরের হলেও শ্রীমতী অষ্টধাতুর বিগ্রহ। যেই যুগল বিগ্রহকে কেন্দ্র করে শান্তিপুরের রাসউৎসব, ভাঙারাসের ঠাকুরনাচ, দোল, ঝুলনযাত্রায় মেতে ওঠেন ভক্তরা। শ্রীরাধারমণ অতীতে পুরীর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে দোলগোবিন্দ নামে পুজো পেতেন। এর বহু কাল পরে বসন্ত রায়ের পরিবার কৃষ্ণবিগ্রহকে তুলে দিলেন তাঁদের গুরুদেব অদ্বৈত-পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে। সেই থেকে এই রাধারমণ বিগ্রহ পূজিত হয়ে আসছেন বড়ো গোস্বামী বাড়িতে।

shantipur baro goswami bari 15.06
বড়ো গোস্বামী বাড়ি।

গোস্বামী বাড়িতে রাধারমণের জামাই-আদর দেখার মতো হয়। জামাইষষ্ঠীর দিন তাঁর বিশেষ পূজা হয়। বলা যেতে পারে জামাইষষ্ঠীর আদর খেতে প্রস্তুত থাকেন তিনি। অতীতে রাধারমণ জিউ শ্বশুরবাড়ির এক মন্দিরে যেতেন জামাইষষ্ঠীর দিন, দুপুরবেলা ভোগ নিবেদনও হত সেই মন্দিরেই। কিন্তু বর্তমানে সেই মন্দিরের ভগ্নদশার। তাই সেখানে কোনো উৎসব পালিত হয় না।

অতীতের রীতিনীতি আজও বর্তমান। আজও শ্বশুরবাড়ি থেকে রাধারমণের জন্য নতুন ধুতি, নতুন বস্ত্র আসে। এই দিন তাঁকে পাখার বাতাস করা হয়। তার পর নৈবেদ্যভোগ নিবেদন। দুপুরবেলা অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। তাতে থাকে সাদাভাত, শাক, শুক্তোনি, ভাজা, মোচার ঘণ্ট, ডাল, এঁচোড়ের তরকারি, ছানার ডালনা, পোলাও, চাটনি, পায়েস, দই এবং নানা রকমের মিষ্টান্ন ইত্যাদি। রাত্রে ভোগে থাকে চিঁড়ে মাখা, মিষ্টি ইত্যাদি।

একেবারে বলা যেতে পারে জামাইষষ্ঠীর দিনে শ্রীশ্রীরাধারমণের বিশেষ যত্নআত্তি করা হয় রাজকীয় ভাবে। পোশাকেও থাকে চমক। পারিবারিক গয়নায় সাজানো হয় রাধারমণ ও শ্রীমতীকে। তবে এ বছরের বিশেষ পরিস্থিতির জন্য বড়ো গোস্বামী বাড়িতে জামাইষষ্ঠীর উৎসব পালিত হবে ভক্তসমাগম ছাড়াই, জানা গেল পরিবারসূত্রে।

শান্তিপুরের চাঁদুনীবাড়িতে জামাইষষ্ঠী

shantipur chadunibari 15.06
চাঁদুনীবাড়ির পুজো।

শান্তিপুর শাক্ত-বৈষ্ণব ও শৈবধারার একত্রিত পীঠস্থান। এখানকার আগমেশ্বরী কালীপুজোর পরই যে পুজোর কথা সবার আগে মনে আসে তা হল মুখোপাধ্যায় পরিবারের চাঁদুনীমায়ের পুজোর কথা। পরিবারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে কাশীনাথ সার্বভৌমের ভাই গোপীনাথ সার্বভৌম তন্ত্রসাধনা করতেন। পরিবারের আদত পদবি মুখোপাধ্যায়। কিন্তু যে হেতু তাঁরা পণ্ডিত ছিলেন সে হেতু তাঁরা ‘সার্বভৌম’ উপাধি পেয়েছিলেন।

গোপীনাথ সার্বভৌম একদিন মায়ের স্বপ্নাদেশ পেলেন – “তোর বাড়ির অদূরে এক কূর্মপীঠ আছে, সেখানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে আমাকে পূজা কর। তুই যে মন্ত্রে আমাকে পূজা করবি, আমি সেই মন্ত্রেই সন্তুষ্ট হব।” সেই থেকে এই পরিবারে কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মুখোপাধ্যায় পরিবারে দুর্গাপুজোও হয় ধুমধাম করে।

মুখোপাধ্যায় পরিবারে যে শিলাময়ী মা ষষ্ঠী রয়েছেন জামাইষষ্ঠীর দিন তাঁর পুজো হয়। এই মা নিত্যসেবিত। ওই দিন আলপনা দিয়ে বেড়াল অঙ্কন করে তার ওপর মাকে বসিয়ে পুজো হয়। বাড়ির পুত্রবধূরা (যাঁদের সন্তান আছে), তাঁরা প্রত্যেকেই ছোট্টো ছোট্টো ৬টি মাটির হাঁড়িতে করে দই নিবেদন করেন মাকে। পুজোর পর তাঁরা সবাই মা ষষ্ঠীর মাথায় জল ঢালেন। জল ঢালার পর দইয়ের হাঁড়িগুলি অদলবদল করা হয়। তার পর বাড়ির পুরুষ সদস্যদের পাখার হাওয়া দিয়ে মায়ের উদ্দেশে নিবেদিত হলুদের ফোঁটা দিয়ে ষষ্ঠীদেবীর আশীর্বাদ দেওয়া হয়। সেই দিন চাঁদুনীবাড়ির পুত্রবধূদের ফলাহার করারই বিধান।

এই বাড়ির গোপাল মূর্তিটি আনুমানিক আড়াইশো বছরের প্রাচীন, মা শিলাময়ীও তা-ই। জামাইষষ্ঠীর দিন দুপুরবেলা বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীকে। তবে মুখোপাধ্যায় পরিবারের নারায়ণশিলাটি চাঁদুনী মায়ের সমসাময়িক সময়ের বলেই উল্লেখ করলেন পরিবারের সদস্য সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন: গোপীনাথ মুখোপাধ্যায়ের পুথি দেখে মা কালীর পুজো হয় শান্তিপুরের চাঁদুনিবাড়িতে

বিজ্ঞাপন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.