শক্তিপদ ভট্টাচার্য
উম্পুনে বিধ্বস্ত সুন্দরবনের অধিবাসীদের বেঁচে থাকার জন্য বড়ো ভরসা এখন বাইরের মানুষের ত্রাণ। কিন্তু এই ত্রাণও অনেক সময়েই সমবণ্টন হচ্ছে না। সুন্দরবনের বসতি এলাকাগুলির সব মানুষের কাছে সমান ভাবে ত্রাণ পৌঁছোচ্ছে না। কেউ কেউ নিয়মিত ত্রাণ পাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ তাঁদের অঞ্চলের দুরধিগম্যতার কারণে নিয়মিত ত্রাণ পাচ্ছেন না। এ ভাবেই ত্রাণের প্রত্যাশায় দিন কাটছে সুন্দরবনবাসীর।
২০ মে ঘূর্ণিঝড় উম্পুন তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়ার পরে বিধ্বস্ত দক্ষিণবঙ্গ, সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত সুন্দরবন। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে রয়েছে ১৯টি ব্লক, ১৩টি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় আর ৬টি উত্তর চব্বিশ পরগনায়। মোট ১০২টি দ্বীপ। তার মধ্যে ৫৪টিতে মানুষ বাস করে। ২০১১ সালের সেনসাস অনুযায়ী লোকসংখ্যা ৪৫ লক্ষ, ১০ বছরে আরও অনেক বেড়েছে।

সুন্দরবন এলাকা বাদ দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের আর যে সব এলাকা দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছে, সে সব জায়গায় বড়ো বড়ো গাছ পড়ে, বাড়ি ভেঙে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বটে, কিন্তু বন্যা হয়নি। কিন্তু সুন্দরবনে সে সব ক্ষতি তো হয়েইছে, তার সঙ্গে এসেছে প্লাবন। ঝড়ের তাণ্ডব গুঁড়িয়ে দিয়েছে বড়ো বড়ো নদীর বাঁধ। প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ মাটির বাঁধ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সেই বীভৎস ভাঙনে ভেসে গিয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। নোনা জলের প্লাবনে চাষের জমি লবণাক্ত হয়ে গিয়েছে। ফলে আগামী কয়েক বছর চাষ করা যাবে না। নোনা জল একের পর এক পুকুর প্লাবিত করে মাছ ও জল নষ্ট করে দিয়েছে। এই গরমে পানীয় জল ও ব্যবহারের জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
সুন্দরবনের এমন ক্ষতি যে কত কত বছর পরে হল তা মনে করতে পারেন না এলাকার অতি বৃদ্ধ মানুষজনও। আয়লার স্মৃতি এখনও তাঁদের মনে দগদগে হয়ে রয়েছে। কিন্তু উম্পুন তো আয়লাকেও হার মানাল।
অভাব, ক্ষুধা আর আশ্রয়হীনতার এক বিশাল হাঁ-মুখ তৈরি হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, এনজিও, সাধারণ ক্লাব, বারোয়ারি পুজো কমিটির মতো বিভিন্ন সংস্থা প্রতিদিন ত্রাণ নিয়ে সেখানে পৌঁছে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বহু মানুষ রোজ ত্রাণ নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন। কলকাতার আশপাশ ছাড়াও বাংলার বহু দূর দূর প্রান্ত থেকেও সাধারণ মানুষেরা ত্রাণ নিয়ে আসছেন। এই দুর্দিনে দুর্গত মানুষের পাশে থেকে একটা বড়ো দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন বাংলার মানুষেরা। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর এ ভাবে যদি একটু উপকার হয়, তার চেষ্টায় সাধারণ মানুষের উদ্বেগ চোখে পড়ার মতো।

কিন্তু এই সাধারণ মানুষ ও কিছু সংস্থার সুন্দরবনের ম্যাপ সম্পর্কে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই। যা আছে ভাসা ভাসা। অনেকে হয়তো কোনো দিনই আসেননি সুন্দরবনে। বইয়ে পড়েছেন, কানে শুনেছেন, সুন্দরবন অতি দুর্গম জায়গা। সেই অস্পষ্ট ধারণা নিয়েই আসছেন। ফলে ত্রাণ সব সময় সঠিক জায়গায় সমান ভাবে পৌঁছোচ্ছে না, সমবণ্টন হচ্ছে না। একই জায়গায় বেশ কয়েক বার ত্রাণ পৌঁছে গেলেও কিছু জায়গায় ত্রাণ যাচ্ছে না। প্রশাসনও সঠিক তালিকা দিতে পারছে না। যার ফলে কেউ বেশি জিনিস পেয়ে যাচ্ছেন, আবার কেউ কিছুই পাচ্ছেন না।
ভরা কোটালে আবার কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এখনও অনেক বাঁধ সারানো যায়নি, যদিও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সারাই চলছে। সামনে বর্ষা কড়া নাড়ছে। তার আগে যতটা সম্ভব কাজ এগিয়ে রাখতে না পারলে আবার মূল বাংলা থেকে দ্বীপভূমিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে আড়ালে চলে যাবে। এক কঠিন দুঃখের চাদরে মুড়ে দুঃস্বপ্ন নিয়ে দিন কাটাবে সুন্দরবন, তখন কোনো খবরেই আর আসবে না।

একে লকডাউন, তার পরে উম্পুন। সবে মিলে কর্মহীনতা। এক কঠিন সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই এলাকা। নোনা জমির কারণে চাষ বন্ধ, জলপথে মাঝিমাল্লার কাজ বন্ধ, মিষ্টি জলের পুকুরে মাছচাষ বন্ধ, লকডাউনের ফলে মাছ ধরার নৌকাগুলোও নদীতে নামার জন্য তৈরি হয়নি, পর্যটনশিল্পও এ বারে জমবে না – সব মিলিয়ে এখন এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে সুন্দরবন এলাকা।
টোটাল অর্থনৈতিক লকডাউনের মাঝেও মানুষগুলো ভাঙা ঘরের খুঁটি দাঁড় করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। জ্বালানির হাজারো সমস্যার মাঝে মা তাঁর বাচ্চাগুলোর জন্য ভাতের উনুনে কাঠের জ্বালে ফুঁ দিয়ে চোখ লাল করছেন। জীবন থেমে নেই, এত সব সয়েও জীবন জেগে আছে সুন্দরবনে।