পরিবেশ বিপর্যয়, সভ্যতার বিলুপ্তি – সরব হোন, সংঘবদ্ধ হোন। এই বিষয়টি সামনে রেখে এ বার অবস্থান-বিক্ষোভ ও প্রচার কর্মসূচি পালিত হল কল্যাণী মেন স্টেশনের সামনে। ‘পরিবেশ বিষয়ক নাগরিক উদ্যোগ’ আয়োজিত ওই কর্মসূচি চলে ৩ অক্টোবর রবিবার সন্ধে ৬টা থেকে রাত প্রায় ৮টা পর্যন্ত।
পরিবেশ রক্ষার দাবিতে আয়োজিত এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ছিল প্রকৃতি-পরিবেশ বিষয়ক লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার, গান ও কবিতা-আলেখ্য। বক্তৃতা করেন বিজ্ঞান আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী ও ‘পরিপ্রশ্ন’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক বঙ্কিম দত্ত, ছাত্র-প্রতিনিধি হিসেবে পরিবেশকর্মী কৌস্তভ বসু ও সৃজন সেন, বিজ্ঞানী ও প্রকৃতিপ্রেমিক ডক্টর জয়দেব জানা প্রমুখ।
আজ বিশ্ব জুড়ে কী ভাবে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে তা বক্তারা সহজ ভাবে বুঝিয়ে দেন। তাঁরা বলেন, পরিবেশের বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তন আজ শুধু সিলেবাসের পাঠ্যবিষয় বা কিছু বিজ্ঞানকর্মীর উষ্মা প্রকাশ নয়, বিষয়টি আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপ্ত। আজকের পরিবেশ আন্দোলন শুধুমাত্র কিছু বৃক্ষরোপণ বা প্লাস্টিক বর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।
আইপিসিসির (Intergovernmental Panel on Climate Change) ষষ্ঠ রিপোর্টের প্রতি ছত্রে ছত্রে যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে বক্তারা তা প্রাঞ্জল ভাবে তুলে ধরেন। একই সঙ্গে উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যে প্লাবন চলছে তার কথাও। অতিবৃষ্টি ও এবং তার জন্য জলাধারগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে জল ছাড়ার কারণে সুন্দরবন, কলকাতা ও শহরতলি এবং হাওড়া-হুগলি-বাঁকুড়া-মেদিনীপুর ইত্যাদি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল বারবার জলমগ্ন হওয়া এবং অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের ৮টি জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষের জল-যন্ত্রণা, বানভাসি হওয়া ও ব্যাপক অঞ্চলের কৃষিজ ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা উঠে আসে।

বড়ো নদীবাঁধের কারণে ফি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকায় বিপর্যয় – কোন ধরনের, কাদের স্বার্থে এবং কীসের বিনিময়ে এই অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা, তা নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও প্রশ্ন তুলে দিলেন একাধিক বক্তা।
ডক্টর জানা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন উচ্চফলনশীল চাষ এবং বোতলবন্দি জল ও কোল্ড ড্রিংকসের জন্য প্রতি মুহূর্তে ভূগর্ভ থেকে গ্যালন গ্যালন জল তুলে নেওয়ার কথা। তিনি বলেন, এর জন্য এক দিকে যেমন ভূগর্ভস্থ জলস্তর দিন দিন নীচে, আরও নীচে নামছে, তেমনই বাড়ছে পানীয় জলের সংকট ও আর্সেনিক-ফ্লোরাইড দূষণ, বাড়ছে মানুষের অসুখ বিসুখ।
বঙ্কিম দত্ত তাঁর বক্তব্যে জোর দিলেন মধ্যবিত্তের বর্তমান সংকটের উপরে। শুধু টাকা ও ভোগ্যপণ্যের পিছনে ছুটতে গিয়ে মধ্যবিত্তের একটা বড়ো অংশ ‘খাও-পিও-জিও’ মতাদর্শের পিছনে অন্ধের মতো ছুটছেন। প্রকৃতির পুনরুদ্ধার ও পুনরুৎপাদনের বিষয়টি তাঁরা সামনে আনতে পারছেন না। তিনি বলেন, কর্পোরেটের স্বার্থে আনা নয়া কৃষি আইনের মধ্য দিয়ে এক দিকে যেমন আরও বেশি করে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে, অন্য দিকে কৃষকরা জমি থেকে উৎখাত হবেন।

ছাত্ররা দাবি তোলেন তথাকথিত উন্নয়ন ও নগরায়নের নামে নির্বিচারে সবুজ বনানী ধ্বংস বন্ধ করতে হবে। প্রশ্ন করতে হবে এত শক্তির আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা। কর্পোরেটের স্বার্থে গাদাগাদা ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন কতটা মানুষের স্বার্থে, মানুষের প্রয়োজনে, সে প্রশ্নও সামনে আনতে হবে। আমাদের স্পষ্ট করে বোঝা দরকার নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুস্থ সুন্দর পরিবেশ, নির্মল আকাশ, দূষণহীন একটা পৃথিবী অত্যন্ত জরুরি। আর একে সত্যি করে তুলতে আমাদের সকলকে সক্রিয় ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
কর্মসূচিতে ছিল নানা বর্ণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। পরিবেশ বিষয়ক একটি সুন্দর ও মনোগ্রাহী কবিতা-আলেখ্য পাঠ করল সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী অদ্রিজা জানা। সমবেত ভাবে গান পরিবেশন করলেন পাভলভ ইনস্টিটিউট (নৈহাটি শাখা)-এর পক্ষ থেকে শ্রীনি তালুকদার, শিখা বিদ ও মৌসুমী ঘোষ। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিজ্ঞান শিক্ষক, পরিবেশ আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী ও ‘পরিপ্রশ্ন’ পত্রিকার অন্যতম সদস্য সন্তোষ সেন।
রবিবারের কর্মসূচি ছিল ‘পরিবেশ বিষয়ক নাগরিক উদ্যোগ’ আয়োজিত দ্বিতীয় কর্মসূচি। উদ্যোগের পক্ষ থেকে প্রথম প্রাণবন্ত ও সফল কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় নৈহাটিতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান বিক্ষোভ ও বর্নাঢ্য সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মেলবন্ধনে। অনেক সংগঠন, সংস্থা ও ব্যক্তিমানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যৌথ উদ্যোগের ধারাবাহিক ভাবে পথ চলা আগামী দিনেও বহাল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করা হয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে।
আরও পড়তে পারেন
পরিবেশ রক্ষায় অভিনব উদ্যোগ নিল সিকিম, ১ জানুয়ারি থেকে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক বোতলে ভরা পানীয় জল
পাহাড় বাঁচাতে অযোধ্যা পাহাড়ে ‘প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও’ মঞ্চের উদ্যোগে জনচেতনা র্যালি
পরিবেশ রক্ষার দাবিতে নৈহাটিতে ‘পরিবেশ বিষয়ক নাগরিক উদ্যোগ’ আয়োজিত অবস্থান বিক্ষোভ
বিটকয়েন মাইনিং পরিবেশের জন্য বড়োসড়ো বিপদের কারণ, বলছে গবেষণা
গত বছর রেকর্ড সংখ্যক পরিবেশকর্মী খুন হয়েছে সারা বিশ্বে
বায়ুদূষণের কারণে উত্তর ভারতের বাসিন্দাদের আয়ু কমে যেতে পারে ন’বছর, দাবি রিপোর্টে
পারদের উত্থান ভাঙছে অতীতের সব রেকর্ড, তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে ইউরোপের একাধিক দেশ
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।