নৈহাটি: ‘পরিবেশ বিপর্যয়, সভ্যতার বিলুপ্তি – সরব হোন, সংঘবদ্ধ হোন’ – এই বিষয়টি সামনে রেখে ২৬ সেপ্টেম্বর, রবিবার বিকেল ৪টে থেকে রাত প্রায় ৯টা পর্যন্ত নৈহাটি জর্জ রোডে স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। আয়োজনে ‘পরিবেশ বিষয়ক নাগরিক উদ্যোগ’।
পরিবেশ রক্ষার দাবিতে আয়োজিত এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ছিল প্রকৃতি-পরিবেশ বিষয়ক লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার, গান, কবিতা, আলেখ্য, নাটক। অনুষ্ঠান চলতে চলতে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা হল বিপর্যস্ত পরিবেশের ওপর দু’টি অসাধারণ অঙ্কনশিল্প। ছাত্র, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বিজ্ঞান ও পরিবেশকর্মীরা তাঁদের বক্তব্যে মূল্যবান বিষয় তুলে ধরেন।
বক্তৃতা দেন কল্যাণী স্টাডি সার্কেলের পক্ষে বিজ্ঞান-শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী সন্তোষ সেন, ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব ও পরিবেশকর্মী অনিমেষ দত্ত এবং শুভ্রদীপ অধিকারী, ‘পরিপ্রশ্ন’ পত্রিকার তরফে বিজন পাল, হালিশহর বিজ্ঞান পরিষদের প্রতিনিধি ও প্রকৃতিপ্রেমিক ত্রিদিব দস্তিদার প্রমুখ।

দীর্ঘ সময় জুড়ে বক্তাদের মূল্যবান বক্তব্য থেকে যে নির্যাস উঠে এল তা হল — পরিবেশের বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তন আজ শুধু সিলেবাসের পাঠ্যবিষয় বা কিছু বিজ্ঞানকর্মীর উষ্মা প্রকাশ নয়। বিষয়টি স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় স্তর থেকে আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপ্ত। সুতরাং আমাদের ভাবতে হবে অনেক বড়ো করে, গভীরে গিয়েই। আজকের পরিবেশ আন্দোলন শুধুমাত্র কিছু বৃক্ষরোপণ বা প্লাস্টিক বর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। আইপিসিসি-র (Intergovernmental Panel on Climate Change, IPCC) ষষ্ঠ রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে তা বক্তারা প্রাঞ্জল ভাবে তুলে ধরেন।

এক দিকে দাবদাহ, অন্য দিকে মেঘভাঙা বৃষ্টি
এক দিকে জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, তীব্র তাপপ্রবাহ, খরা, দাবানল বায়ুদূষণ। অন্য দিকে হিমালয় ও মেরুপ্রদেশের বরফের অতি দ্রুত গলন, সমুদ্র জলের উচ্চতা ও উষ্ণতা দূই’ই বেড়ে যাওয়া। এরই হাত ধরে পৃথিবীর এক প্রান্ত তীব্র দাবদাহে হাঁসফাঁস করছে, দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে হেক্টরের পর হেক্টর বনাঞ্চল, দানবীয় ঝড়ঝঞ্ঝায় বিপর্যস্ত হচ্ছেন এক বড়ো অংশের জনগণ। ঠিক একই সময়ে অন্য প্রান্তের মানুষ মেঘভাঙা বৃষ্টি, অল্প সময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি, বন্যা-প্লাবনে আক্রান্ত, যা দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতে বিভিন্ন প্রদেশেও।

তথাকথিত উন্নয়নের নামে ধ্বংসযজ্ঞ
তথাকথিত উন্নয়ন ও নগরায়নের নামে নির্বিচারে সবুজ বনানী ধ্বংস বন্ধ করতে হবে। কাদের জন্য এবং কীসের বিনিময়ে উন্নয়ন সেই প্রশ্ন করতে হবে। প্রশ্ন করতে হবে এত শক্তির আদৌ প্রয়োজন আছে কি না। কর্পোরেটের স্বার্থে গাদাগাদা ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন কতটা মানুষের স্বার্থে, মানুষের প্রয়োজনে, এই সব প্রশ্নকেও সামনে আনতে হবে।
আমাদের স্পষ্ট বুঝে নিতে হবে নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ, নির্মল আকাশ, দূষণহীন একটা পৃথিবী রেখে যাওয়ার জন্য আমাদের সকলকে সক্রিয় ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। জীববৈচিত্র্য ও মানবসভ্যতাকে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে বাজার-সর্বস্ব পণ্য উৎপাদনের জগৎ থেকে বেরিয়ে মানুষের ন্যুনতম প্রয়োজনভিত্তিক, সহযোগিতামূলক উৎপাদনের দাবি সামনে আনতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের, সমাজ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠে আমাদের প্রকৃতিকেন্দ্রিক ভাবনায় জারিত হতে হবে, চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে, প্রকৃতির পুনরুদ্ধার ও পুনরুৎপাদনের কথা আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের জোটবদ্ধ হতেই হবে। বিপর্যস্ত পরিবেশ মেরামতির দাবিতে বিশ্ব জুড়েই লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী, যুবাবাহিনী, বিজ্ঞান ও পরিবেশকর্মীদের যে লড়াই-আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন ধরে, তাকে শক্তিশালী করতে আমাদের হাতটা বাড়িয়ে দিতেই হবে।

পরিবেশ-সংক্রান্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
বক্তব্যের মধ্যেই ছিল শিল্পী-সাহিত্যিক-কবিদের নানা বর্ণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পরিবেশ বিষয়ক একটি আলেখ্য পাঠ করলেন ‘পরিপ্রশ্ন’ পত্রিকার তরফে শিক্ষিকা সুপর্ণা দে, একটি ইংরেজি কবিতা পাঠ ও পরিবেশ বিষয়ক কয়েকটি অনুভূতির কথা তুলে ধরলেন ছাত্রবন্ধু সৃজন সেন। সমবেত ভাবে গান পরিবেশন করলেন ‘অগ্নিবীণা’ সাংস্কৃতিক সংস্থা, হালিশহর সাংস্কৃতিক পরিষদ, নৈহাটি জুভেনাইল অ্যাসোসিয়েশনের শিল্পীরা এবং পাভলভ ইনস্টিটিউট নৈহাটি-এর পক্ষ থেকে প্রণতি ঘোষ, সান্ত্বনা আচার্য ও শীলা দেবনাথ। ‘জঙ্গল ছোড়াব নেহি — লড়াই ছোড়াব নেহি’ গানটি দৃপ্তকণ্ঠে গাইলেন ছাত্রবন্ধু রিতেশ দাশ।
অরণ্য সংরক্ষণ বিষয়ের ওপর একটি দুর্দান্ত প্রাণবন্ত নাটিকা পরিবেশন করলেন পিএনএসি-এর কুশীলবেরা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলার পাশাপাশি ‘শিল্পবিতান’ সংস্থার দুই ছাত্র ছাত্রী পরিবেশকে কেন্দ্র করে দু’টো সুন্দর চিত্র আঁকল ক্যানভাসভরে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিজ্ঞান আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী, ‘পরিপ্রশ্ন’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক বঙ্কিম দত্ত।

শুরু হল পথ চলা
উদ্যোক্তারা চেয়েছিলেন বিপর্যস্ত প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশকে পুনরুদ্ধার করার দাবিতে একটি যৌথ মঞ্চ গড়ে উঠুক। মূলত এনআইএসসি-র (নৈহাটি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড কালচার) সদস্যরা করোনা সংক্রমণের প্রথম পর্বে উদ্যোগটি শুরু করেন। সঙ্গে যুক্ত হলেন নৈহাটি, হালিশহর, কল্যাণীর বেশ কয়েকটি ক্লাব ও সংগঠন এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকরা। গড়ে উঠল ‘পরিবেশ বিষয়ক নাগরিক উদ্যোগ’। এই উদ্যোগের প্রথম কর্মসূচি ছিল এই অবস্থান বিক্ষোভ। অনেকগুলো সংগঠন, সংস্থা ও ব্যক্তিমানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যৌথ উদ্যোগের পথ চলা শুরু হল এ ভাবেই।
৫০ জনের অধিক মানুষের উপস্থিতি ও সক্রিয়তায় প্রথম যৌথ উদ্যোগের কর্মসূচি সফল ভাবে সম্পন্ন হওয়াটা উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করল। এই ধরনের উদ্যোগ ডালপালা মেলে বিকশিত হোক পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতেও। আসুন হাতে হাত রেখে চলি, জোট বাঁধি নিজেদের স্বার্থেই।
আরও পড়তে পারেন
বিটকয়েন মাইনিং পরিবেশের জন্য বড়োসড়ো বিপদের কারণ, বলছে গবেষণা
গত বছর রেকর্ড সংখ্যক পরিবেশকর্মী খুন হয়েছে সারা বিশ্বে
বায়ুদূষণের কারণে উত্তর ভারতের বাসিন্দাদের আয়ু কমে যেতে পারে ন’বছর, দাবি রিপোর্টে
পারদের উত্থান ভাঙছে অতীতের সব রেকর্ড, তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে ইউরোপের একাধিক দেশ
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।