অযোধ্যা পাহাড় (পুরুলিয়া): এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অযোধ্যা পাহাড় (আয়োদিয়া বুরু)-এর ৬২টি গ্রামে একনাগাড়ে জনচেতনা বৈঠক চলছিল। ধর্ম কিংবা আদিবাসী জাতিগুলির মধ্যেকার নানা রকম বিভাজন ও মতানৈক্য ছাপিয়ে সর্বত্র ‘প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও’ মঞ্চের প্রতিনিধি-সদস্যরা মুনাফাখোর ষড়যন্ত্রীদের আগ্রাসন থেকে পাহাড়ের মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতিকে আগলে রাখার আহ্বান জানান। সেই আহ্বান সাঁওতালি-মুন্ডারি-বাংলা ভাষার ভেলায় চেপে তৈরি করছিল আহ্বায়ক ও আহূতদের মধ্যে এক স্বতস্ফুর্ত কথপোকথন।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ঠুড়গা পাম্পড পাওয়ার স্টোরেজ প্রকল্পের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে চিরবঞ্চিত চিরশোষিত জঙ্গলমহলবাসীর যে নবপর্যায়ের অধিকার আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল, তা তিন বছর পেরিয়ে অযোধ্যা পাহাড় ও তার বাইরের বিস্তীর্ণ পশ্চিমবঙ্গীয় বনাঞ্চলে বহুমুখী বঞ্চনা ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটা ঝোড়ো হাওয়াই তুলে দিয়েছে বলা যায়। যে কারণে জনচেতনা বৈঠকগুলিতে শুধু ঠুড়গা প্রকল্পের বিরোধিতাই নয়, বান্দু, কাঁঠালজলের সম্ভাব্য প্রকল্প, এমনকি বীরবুরু (পাহাড়-জঙ্গল) ধ্বংস করতে পারে এমন যে কোনো ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাহাড়বাসী একজোট হওয়ার আশা দেখাচ্ছেন।
বিষয়টি শুধু সরকার-কোম্পানির তথাকথিত ‘শিল্পোন্নয়ন’ বিষয়ক আগ্রাসনেই আটকে নেই, বন-পাহাড়ের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণপরিবহণের প্রতি কী ব্রিটিশ কী স্বাধীন ভারতের সরকার যে চিরাচরিত অবহেলা দেখিয়ে এসেছে এবং মানুষগুলির যুগলালিত প্রাণ-প্রকৃতি সংবেদী গভীর সংস্কৃতির উপর যথেচ্ছ আগ্রাসন চালিয়ে আসছে, তা রুখে দেওয়ার দাবিও উঠছে সজোরে, সশব্দে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।

জঙ্গলবাসী মানুষ শুধু অধিকারের ভাষায় কথা বলেই ক্ষান্ত নন, আওয়াজ উঠছে আবিশ্ব জলবায়ু সংকটের প্রেক্ষিতে বনানী ও তার সন্তানদের ট্যুরিজম-বাণিজ্যের বিষ থেকে রক্ষা করার শপথ।
ঠুড়গা প্রকল্পবিরোধী আন্দোলন প্রকৃতার্থে আয়োদিয়া বুরু বাঁচাও আন্দোলন হয়ে উঠছে ভিতর থেকে। এই ভিতর থেকে ফুটে ওঠার সুবাস পাহাড়ের প্রান্তে-উপান্তে পৌঁছে দিতেই গত ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর পাহাড়ব্যাপী ৬২টি গ্রামে জনসচেতনতা র্যালির ডাক দিয়েছিল ‘প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও’।
এই জনচেতনা র্যালি আটকানোর জন্য স্বার্থলোলুপ মহল থেকে নানা ভাবে চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সমস্ত দ্বিধা ও ভয় উড়িয়ে দিয়ে বিশাল র্যালি বের হয় হিলটপ থেকে।

প্রথম দিন ২৭ তারিখ পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে খয়রাবেড়ার মুখ পর্যন্ত ৩০টি গ্রামের মধ্যে দিয়ে র্যালি চলতে থাকে। ১৫টি জনবহুল স্থানে পথসভা হয়। তেলিয়াভাসা গ্রামের বাসিন্দারা সকলে মিলে ব্যবস্থা করেন র্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের দ্বিপ্রাহরিক আহারাদির৷ রাত সাড়ে নটায় শেষ হয় প্রথম দিনের কর্মসূচি।
পরের দিন অর্থাৎ ২৮ তারিখও উজ্জীবিত র্যালি বের হয় তেলিয়াভাসা গ্রাম থেকে পাহাড়ের পুব দিকের বাকি ৩২টি গ্রামে। সাপারামবেড়ার গ্রামবাসীরা আহারাদির ব্যবস্থা করেন।
দু’ দিনই দাবি সংবলিত ব্যানার-পোস্টারে সজ্জিত ট্যাবলো ও মিছিল দেখতে এবং যোগ দিতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। সংরক্ষিত বন-পাহাড়ের বাসিন্দাদের ব্যক্তি ও সমষ্টিগত অধিকার সম্পর্কে ২০০৬ সালের বনাধিকার আইনে যা বলা হয়েছে সে বিষয়ে বক্তৃতা মনযোগ দিয়ে শোনেন তাঁরা। নিজেদের মতামতও তুলে ধরেন অনেকে।

র্যালি এগোতে দেরি হলেও কয়েকটি গ্রামের মানুষ রাত পর্যন্ত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন। র্যালির সঙ্গেই প্রত্যেক গ্রামে ‘প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও’ মঞ্চের পতাকা উত্তোলন হয়। র্যালির আবহসংগীত ছিল ওড়িশার ভগদান দাস মাঝির আন্দোলনের গান ‘গাঁও ছোড়ব নহি, জঙ্গল ছোড়ব নহি…’, সঙ্গে ছিল ধামসা মাদলের সুরতালছন্দ।
‘প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও’ মঞ্চের প্রতিনিধিরা জানান, তাঁরা পাহাড় তথা জঙ্গলমহলে উঠতে থাকা এই আন্দোলনের তরঙ্গকে কোনো রাজনৈতিক দলের পচাডোবায় পরিণত হতে দেবেন না। হাইকোর্টে অযোধ্যা মামলার শুনানিতে এই জনচেতনা র্যালির ঢেউ এসে লাগুক, অযোদিয়া বুরু বাঁচাও সংহতিমঞ্চ এই আশাই করে।
আরও পড়তে পারেন
পরিবেশ রক্ষার দাবিতে নৈহাটিতে ‘পরিবেশ বিষয়ক নাগরিক উদ্যোগ’ আয়োজিত অবস্থান বিক্ষোভ
বিটকয়েন মাইনিং পরিবেশের জন্য বড়োসড়ো বিপদের কারণ, বলছে গবেষণা
গত বছর রেকর্ড সংখ্যক পরিবেশকর্মী খুন হয়েছে সারা বিশ্বে
বায়ুদূষণের কারণে উত্তর ভারতের বাসিন্দাদের আয়ু কমে যেতে পারে ন’বছর, দাবি রিপোর্টে
পারদের উত্থান ভাঙছে অতীতের সব রেকর্ড, তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে ইউরোপের একাধিক দেশ