নিজস্ব সংবাদদাতা, জলপাইগুড়ি: অবশেষে কড়া পদক্ষেপ। ময়নাগুড়ি সুভাষনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অঙ্কের প্রশ্নফাঁস কাণ্ডে প্রাথমিক তদন্তের পর শাস্তি ঘোষণা করল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। মূল অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক হরিদয়াল রায়কে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তবে একই সঙ্গে শাস্তির মুখে পড়েছেন অভিযোগকারীরাও। বৃহস্পতিবার বিকেলে কলকাতায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দফতরে সাংবাদিক সন্মেলন করে প্রশ্নফাঁস কাণ্ডে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান পর্ষদ সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলি।
এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন অঙ্কের প্রশ্নপত্রের প্যাকেট সময়ের আগেই খুলে ফেলার অভিযোগ ওঠে জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি সুভাষনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরিদয়াল রায়ের বিরুদ্ধে। ঘটনায় ওই বিদ্যালয়ের আরও কয়েক জন শিক্ষক, শিক্ষিকার নাম জড়িয়ে যায়। প্রশ্নপত্র বার করে তা সমাধান করে বিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে সেই সমাধান পাঠানোর অভিযোগও ওঠে। শুধু অঙ্ক নয়, আগে হয়ে যাওয়া ভূগোল-সহ সব পরীক্ষাতেই ওই ছাত্রকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে এই কাণ্ড মাধ্যমিক শুরুর প্রথম দিন থেকেই ঘটানো হচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগকারীদের বক্তব্য, নিজের বিদ্যালয়ের ছাত্রকে মেধাতালিকায় স্থান পাইয়ে বিদ্যালয়ের সুনাম বাড়াতেই এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে পর্ষদ।
বৃহস্পতিবার তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট জমা পড়ে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। সেইমতো এ দিন বিকেলে সাংবাদিক সন্মেলনে জানানো হয়, পর্ষদের তরফে মোট চার জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সুভাষনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরিদয়াল রায়কে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হবে। সময়ের আগে সিল করা প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলায় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

অন্য দিকে ইতিহাসের শিক্ষক সম্রাট বিশ্বাসকে ‘সতর্ক’ করা হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তদন্তের সময় তিনি বারবার তাঁর বয়ান বদলেছেন। অ্যাডিশনাল ভেনু সুপারভাইজার মণ্টু রায়ের বিরুদ্ধেও কাজে গাফিলতির অভিযোগে বিভাগীয় তদন্ত চলবে। শাস্তির মুখে পড়েছেন এই ঘটনা যাঁর মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছিল সেই ইংরেজির শিক্ষক বিশ্বজিৎ রায়ও। তাঁর করা একটি ভিডিও ক্লিপিংসের মধ্যেমেই প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। স্ট্রং রুমের ভেতরে নিয়ম ভেঙে সেই ভিডিও ক্লিপিংস তোলায় তাঁর বিরুদ্ধেও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ এনে বিভাগীয় তদন্ত চালাবে পর্ষদ।
এর পাশাপাশি পর্ষদের সুপারিশে রাজ্য স্কুল শিক্ষা দফতর ‘শোকজ’ করেছে ময়নাগুড়ির অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক বিশ্বনাথ ভৌমিককে। পর্ষদ সভাপতি জানিয়েছেন, তদন্তের সময় পর্ষদকে বিভ্রান্তিজনক তথ্য দিয়েছেন তিনি। সংবাদ মাধ্যমের কাছেও বিভ্রান্তিকর তথ্য পেশ করেছেন বারবার। কিন্তু যে হেতু তিনি শিক্ষা দফতরের কর্মী তাই পর্ষদের সুপারিশে শিক্ষা দফতর বৃহস্পতিবার তাঁকে শোকজ নোটিশ পাঠায়।
পর্ষদ সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলি জানিয়েছেন, সময়ের আগে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলার অভিযোগ প্রাথমিক ভাবে প্রমাণ হওয়াতে এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর যা তথ্য পাওয়া যাবে তার ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে পর্ষদ সভাপতির দাবি, এই প্রশ্নপত্র দিয়ে কোনো ছাত্র বিশেষ সুবিধা পায়নি বলেই প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ মিলেছে।

এ দিকে এই শাস্তির খবর ছড়িয়ে পড়তেই ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ছড়িয়েছে সমাজের সব স্তরেই। অভিযুক্তদের পাশাপাশি অভিযোগকারীদেরও শাস্তির মুখে পড়তে হওয়ায় উঠেছে প্রশ্নও। যেমন ইংরেজির শিক্ষক বিশ্বজিৎ রায় জানিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ মাথায় রেখেই তিনি মোবাইলে গোপনে স্ট্রংরুমে ভিডিও করেছিলেন। না হলে এই ঘটনা সামনে আসত না। তাঁর বক্তব্য, প্রধান শিক্ষককে সাসপেন্ডের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে দিয়েছে অভিযোগ সত্যি।
তবে ‘শোকজ’ করা নিয়ে বেজায় ক্ষুদ্ধ বিদ্যালয় পরিদর্শক বিশ্বনাথ ভৌমিক। তিনি জানিয়েছেন, ঘটনার সঠিক তদন্ত হচ্ছে না। প্রধান শিক্ষকের সাথে আরও যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা জড়িত তাঁদের সবাইকে এখনও জেরাই করা হয়নি। তার ওপর প্রাণঘাতী হামলার খোঁজখবর না নিয়ে উলটে তাঁকেই শোকজ করায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তিনি।
তবে এই ঘটনার মূল নায়ক হরিদয়াল রায় এখনও ‘ভাঙলেও মচকাবেন না’ এমন মনোভাব নিয়েই চলছেন। শাস্তির কথা জানার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া, কাজের সুবিধার্থে কয়েক মিনিট আগে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুলে তিনি কোনো অন্যায় করেননি। তবে পর্ষদ যদি সেটাকে অপরাধ মনে করে তবে শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত তিনি। সূত্রের খবর, প্রধান শিক্ষকের ‘শিক্ষারত্ন’ সম্মান ফিরিয়ে নিতে পারে রাজ্য শিক্ষা দফতর।
তবে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এখনও বাকি। তার পরেই বোঝা যাবে ভেতরের জল কত দূর গড়িয়েছে। আপাতত সেই দিকেই তাকিয়ে রাজ্যবাসী।