ভক্তসমাগম ছাড়াই নবদ্বীপে আজ পালিত হচ্ছে নবদ্বীপে মহাপ্রভুর ‘জামাইষষ্ঠী’

0
ধামেশ্বর মহাপ্রভু ও তাঁর ভোগ।

শুভদীপ রায় চৌধুরী

আজ জামাইষষ্ঠী। হিন্দু বাঙালির ঘরে আজ যেন এক উৎসব। এই দিনে জামাইদের আদরযত্ন করে বিভিন্ন পদ রান্না করে খাওয়ান শাশুড়িরা। জামাইরাও এক হাতে ইলিশমাছ আর অন্য হাতে রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে উপস্থিত হন শ্বশুরবাড়িতে। তবে নবদ্বীপবাসীর কাছে এই দিন জামাই একজনই। তিনি হলেন বাংলা নব জাগরণের পথিকৃৎ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। এই একটি দিন তিনি সকলের জামাই।

“উঠো উঠো গোরাচাঁদ নিশি পোহাইলো/নদীয়ার লোক সবে জাগিয়া উঠিল…।”

আনুমানিক সাড়ে তিনশো বছর ধরে জামাইষষ্ঠীর প্রথা চলে আসছে নবদ্বীপের  শ্রীচৈতন্যদেবের মন্দিরে। ঐতিহ্যপূর্ণ এই মন্দিরে আজও এই উৎসব পালিত হয়, মহাপ্রভুকে জামাতা হিসাবে এই একদিনই পান তাঁরা। আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা নবদ্বীপ, সঙ্গে থাকে জামাইষষ্ঠীর রীতিনীতি পালন।

উল্লেখ্য, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব এক ফাল্গুনী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় নবদ্বীপে আবির্ভূত  হয়েছিলেন। বাবা জগন্নাথ মিশ্র, মা শচীদেবী। বাংলাদেশের শ্রীহট্ট থেকে তাঁরা এসেছিলেন নবদ্বীপে সংস্কৃত শাস্ত্রচর্চার জন্য। প্রথম পত্নী লক্ষ্মীপ্রিয়াদেবীর মৃত্যু ঘটলে, মহাপ্রভু মায়ের অনুরোধে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীকে বিবাহ করেন। ধামেশ্বর মহাপ্রভু নামে চৈতন্যদেবের যে দারুমূর্তি নদিয়ায় প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী নিজে সেই বিগ্রহের সেবা করতেন। ধামেশ্বরের দারুময় মূর্তি বছরের বাকি দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য হিসাবে সেবিত হলেও জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিনে তিনি হয়ে ওঠেন ঘরের জামাই, অর্থাৎ বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর জামাই।

ধামেশ্বর মহাপ্রভুর মন্দিরে

এই দিনে ‘জামাই’য়ের যথাযথ আদরের জন্য সমস্ত কিছুর আয়োজন থাকে। নবদ্বীপের সেই মন্দিরে কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে সেই রীতি। কথা হচ্ছিল ধামেশ্বর মহাপ্রভুর সেবায়েত প্রভুপাদ শ্রীরূপ গোস্বামীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, এ বছর সমস্ত নিয়মই মন্দিরে পালিত হচ্ছে। তবে প্রশাসনের নির্দেশ মেনে কোনো ভক্তকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ষষ্ঠীর দিনে মহাপ্রভুর বিশেষ ভোগরাগের কথাও জানালেন গোস্বামীপ্রভু।

dhameshwar 2 16.06

আজ সকালে মঙ্গলারতি কীর্তনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে উৎসব সূচনা। তার পরই নিবেদিত হয়েছে বাল্যভোগ – নবদ্বীপের প্রবীণ মহিলারা মহাপ্রভুকে ষষ্ঠীর ‘বাটা’ দেন বা বলা যেতে পারে ষষ্ঠীর ‘ষাট’ দেন। তালপাতার হাতপাখায় বেঁধে আমপাতা, দূর্বা, লালসূতা ইত্যাদি উপকরণ দিয়ে এবং তাঁরা ছড়া কেটে কেটে মহাপ্রভুকে ষষ্ঠীর ষাট দিয়েছেন।

বারোমাসের ষষ্ঠীর ছড়া কাটা শেষ হতেই চিঁড়ে, মুড়কি, দই, আম, কাঁঠাল ইত্যাদি দেওয়া হয়েছে। এর পর তাঁকে নিবেদন করা হবে মধ্যাহ্নভোগ। ভোগে থাকে  সাদাভাত, খিচুড়ি, পোলাও, ফ্রাইডরাইস, লুচি, রাধাবল্লভি, কচুশাক, মোচার ঘণ্ট, শুক্তোনি, পাঁচ রকম ভাজা, ডাল, তরকারি, ধোঁকার ডালনা, ছানার ডালনা, পনীরের তরকারি, লাউ, চালকুমড়ো আমক্ষীর, কর্পূর দিয়ে সাজা সুগন্ধিপান, গোকুলপিঠে, পাটিসাপ্‌টা, লবঙ্গলতিকা, রসগোল্লা ইত্যাদি। এর পর বিকালে হবে উত্থানভোগ অর্থাৎ রুপোর পাত্রে ছানা আর মিষ্টি। রাত্রে ভোগে থাকে ঘিয়ের লুচি, মালপোয়া, নানা রকমের মিষ্টান্ন আর পান।

যেন নতুন জামাই

শুধুমাত্র খাবারেই নয়, পোশাকেও থাকে জামাইসজ্জা। নতুন ধুতি, পাঞ্জাবি, গলায় রজনীগন্ধা আর গোলাপের মালা – যেন নতুন জামাই।

বোঝাই যাচ্ছে এই দিনটিতে প্রতিটি পরিবারের মেয়ের মায়েরা মহাপ্রভুকে পাখার বাতাস দিয়ে জামাইষষ্ঠীর উৎসব পালন করেন। প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই প্রথা আজও যেন অবিকল এক রকম। ঐতিহ্যই মূলকথা এই নবদ্বীপে। তবে সমস্ত নিময়ই পালিত হচ্ছে ভক্তসমাগম ছাড়াই।

আরও পড়ুন: শান্তিপুরে শ্রীরাধারমণের জামাইষষ্ঠী, পিছিয়ে নেই চাঁদুনীবাড়িও

বিজ্ঞাপন